অন্যান্য সাহিত্যিক

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী – এক ‘নিঃসঙ্গ লেখক’

আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের এক অন্যতম লেখক হলেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী (১৯১২ – ১৯৮২)। তিনি যেমন গল্প লিখেছেন তেমন লিখেছেন অনেক উপন্যাসও। তিনি লিখেছেন নিজের মত, সাহিত্যকে ভালোবেসে। মনের খেয়ালে একের পর এক সৃষ্টি করে গেছেন নানা গল্প, নানা উপন্যাস। তবুও তিনি সম্পূর্ন আলাদা এক ব্যক্তিত্ব – এক ‘নিঃসঙ্গ লেখক’।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ শে আগষ্ট আধুনিক বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা অপূর্বচন্দ্র নন্দী ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। মাতার নাম ছিল চারুবালা দেবী। জন্মের পর পিতামাতা কর্তৃক তাঁর নাম হয়েছিল ‘ধনু’। ছোট থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকা, সাহিত্যপাঠ করতে থাকেন। শুধু পড়াশোনা বা অঙ্কনবিদ্যায় নয়, ছোট থেকেই খুব ভালো আবৃত্তিও করতে পারতেন জ্যোতিরিন্দ্র। ১৯৩০ খ্রিঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই সি এস পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করেন। সময়কালটা ১৯৩২ খ্রিঃ। এই সময়েই রাজনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। জেল থেকে ছাড়া পান দুবছর বাদে ১৯৩৪ খ্রিঃ। এরপর ১৯৩৫ খ্রিঃ তিনি বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

কর্মজীবন

কর্মের সন্ধানে জ্যোতিরিন্দ্র প্রথমবার কলকাতা আসেন ১৯৩৬ খ্রিঃ। কলকাতায় এসে প্রথমে তিনি বেঙ্গল ইমিউনিটিতে যোগ দেন। এরপর কখনও টাটা এয়ারক্র্যাপ্ট কখনও ওয়ালটার থমসনে। এর পাশাপাশি ‘দৈনিক যুগান্তর’, ‘দৈনিক জনসেবক’, ‘দৈনিক আজাদ পত্রিকা’তেও কাজ করেছেন তিনি। নিজে সম্পাদনা করেছেন ‘মজদুর’ নামক একটি পত্রিকা যা বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত হত। জীবনের শেষ কুড়ি বছর তিনি আর কোথাও চাকরি করেননি। নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন সাহিত্যচর্চায় – পুরোপুরি।

বিবাহিত জীবন

লেখক তখন কলকাতায় ওয়াল্টার থমসনে কর্মরত। বিবাহের জন্য পাত্রী দেখতে গেলেন। পাত্রী ছিলেন কামিনীকুমার ধর চৌধুরীর কন্যা পারুল দেবী। তিনি সেসময় প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণা। পাশাপাশি সেতার বাদনেও ছিল তাঁর দক্ষতা। সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর বন্ধু গণেশ বাবুকে যার গায়ের রঙ ছিল মিশমিশে কালো। এ প্রসঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রের একটি বক্তব্য তাঁর রসিকমনের পরিচয় দেয় –

        “ও (বন্ধু গণেশ) পাশে থাকলে আমায় দেখতে একটু ভাল লাগবে, তাই নিয়ে গিয়েছিলাম গণেশকে”

যাইহোক পারুল দেবীর সঙ্গে ১৯৪৬ খ্রিঃ ১৭ই ফেব্রুয়ারি বিবাহ হয় জ্যোতিরিন্দ্রের। সীমিত আয়ের মধ্য দিয়েই বহন করেছেন সংসারের যাবতীয় খরচ। পড়াশোনা করিয়েছেন পুত্র কন্যাদের।

সাহিত্যজীবন

সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তাঁর ছোটবেলা থেকেই। লেখালেখি শুরু ছাত্রজীবন থেকেই। ঐ সময়কাল থেকেই তিনি কুমিল্লার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকার ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকায় গল্প লিখেছেন জ্যোৎস্না রায় ছদ্মনামে। পরবর্তীকালে কলকাতার বিভিন্ন সাপ্তাহিক যেমন ‘সংবাদ’, ‘আত্মশক্তি’, ‘নবশক্তি’তেও লিখেছেন নানা গল্প। কিন্তু ‘পূর্বাশা’র সঞ্জয় ভট্টচার্য আর ‘দেশ’ -এর সাগরময় ঘোষের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর যথার্থ পদার্পণ। ১৯৩৬ খ্রিঃ ‘দেশ’ -এর পাতায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘রাইচরণের বাবরি’। ‘পূর্বাশা’য় প্রকাশিত হয় তাঁর গল্প ‘অন্তরালে’।

সাহিত্যসৃষ্টি

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী র গল্পগ্রন্থের সংখ্যা কুড়ি আর উপন্যাস আছে তিপান্নটি। তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘খেলনা’ (১৯৪৬) ‘পূর্বাশা’র সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। আর প্রথম উপন্যাসের নাম ‘সূর্যমুখী’ (১৯৫১)। তাঁর অন্যান্য কয়েকটি গল্পগ্রন্থের নাম – শালিক কি চড়ুই (১৩৬১ বঙ্গাব্দ), চন্দ্রমল্লিকা (১৩৫৩বঙ্গাব্দ), চারইয়ার (১৩৬১ বঙ্গাব্দ), বনানীর প্রেম (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), মহিয়সী (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), ছিদ্র (১৩৮৩ বঙ্গাব্দ)।

অন্যান্য কয়েকটি উপন্যাস হল – মীরার দুপুর (১৯৫৩), বারো ঘর এক উঠোন (১৯৫৫), নীল রাত্রি (১৯৫৮), আলোর ভুবন (১৯৬২), আকাশলীনা (১৯৬৪), প্রেমের চেয়ে বড় (১৯৬৬), সুনন্দার প্রেম (১৯৬৭) ইত্যাদি।

সাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র

জ্যোতিরিন্দ্রের উপন্যাসে ‘গল্পের আবর্তন আছে’ (ড. ক্ষেত্র গুপ্ত)। ‘তিনি আমাদের মধ্যবিত্ত সংস্কারে তীব্র আঘাত হেনেছেন’ (অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়)। শুধু তাই নয়, তিনি ‘সমাজে নারীর অবস্থান বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন’ (ড. ক্ষেত্র গুপ্ত)। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সূর্যমুখী’তে আছে বাংলাদেশের এক মফস্বল শহর কুমিল্লার পটভূমি। এই উপন্যাসে মধ্যবিত্ত সমাজের অবক্ষয়ের চিত্র ধরা পড়েছে। ‘নীলরাত্রি’ উপন্যাসে স্বামীর অত্যাচারের কথা, মনস্তাত্ত্বিকতা আছে। নায়ক চরিত্রের বর্বরতা, নিষ্টুরতা, নায়িকার মনের জটিলতা প্রকাশ পেয়েছে লেখকের ‘হৃদয় জ্বালা’ উপন্যাসে। তবে তাঁর সুপরিচিত ও বিখ্যাত উপন্যাসটির নাম ‘বারো ঘর এক উঠোন’। এই উপন্যাসে কয়েকটি পরিবারের কাহিনী বলেছেন লেখক যারা একই বাড়িতে থাকে। যাদের ঘর পৃথক কিন্তু উঠোন এক। এই উপন্যাসে লেখক কয়েকঘর ভাড়াটের কথা বলেছেন। উপন্যাসের পরিকল্পনায় আছে অভিনবত্ব। এই উপন্যাসটি সম্পর্কে পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন –

        ‘বারো ঘর এক উঠোন’ লেখার পর সমালোচকদের নিন্দা আক্রমণের যেমন কমতি ছিল না, তেমনি আমার ভাগ্যে প্রশংসা বাহবাও অজস্র জুটেছিল। পাল্লার কোন দিকটা ভারি ছিল বলা মুশকিল। ওজন করে দেখিনি। দেখার উৎসাহ ছিল না”। (‘আমার সাহিত্যজীবন আমার উপন্যাস’ – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী)

এমনই ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী।

শেষকথা

কিন্তু তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা কী ? অন্য কোন লেখকের প্রভাব আছে তাঁর রচনায় ? এ বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকারে দেওয়া তাঁর নিজের বক্তব্য –

        “সচেতনভাবে কারো অনুসরণ করিনি। বরং অন্যের মত লিখব না – এমন একটা সংকল্পই ছিল মনে মনে। . . . পারিপার্শ্বিকের প্রভাব আমার ওপরে পড়েছে। যখন যে পরিবেশে থেকেছি তখন সেই পরিবেশের।”

হ্যাঁ। তিনি লিখেছেন নিজের খেয়াল বশে। তাঁর মাথায় যখন যেমন ভাবনা তখন সেই ভাবনাকে সম্বল করে লিখে গেছেন। তাঁর লেখা সম্পর্কে গৌরকিশোর ঘোষ লিখেছিলেন – ‘এক ধরনের সূক্ষ্ম মনস্তত্ব যা জ্যোতিরিন্দ্র ছাড়া অন্য কোনও লেখকের রচনায় ধরা পড়ে না’। আর এক কথাসাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ বলেছিলেন – ‘প্রকৃতিকে এমন জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখিনি আর কারোর লেখায়’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন – ‘তিনি লেখকদের লেখক’। ‘শিলাদিত্য’ পত্রিকার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত নিতাই বসুর ‘নিঃসঙ্গ লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী’ নিবন্ধে লেখক যথার্থ বলেছেন –

        “. . . একমাত্র সাহিত্যের আয়ের উপর ভরসা করে বেঁচে থাকা এদেশে নন কমার্শিয়াল লেখকদের মধ্যে এ ব্যাপারে সম্ভবত একমাত্র মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই তাঁর তুলনা চলে।

তথ্যসূত্র – বাংলা উপন্যাসের ইতিকথা – (ড. ভূদেব চৌধুরী), বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস (ড. ক্ষেত্র গুপ্ত), মধ্যাহ্ন থেকে সায়াহ্নে বিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাস (ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়), আনন্দবাজার পত্রিকা (২১ আগষ্ট, ২০১৩)

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *