বৈষ্ণব পদাবলি

মরমী কবি জ্ঞানদাস

জ্ঞানদাস ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে বর্ধমান জেলার কাঁদড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন । বৈষ্ণবপদাবলীর রচয়িতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম । আধুনিক কালের লিরিক প্রতিভা বলতে যা বুঝি তা এককথায় জ্ঞানদাসের। অনুভূতির গভীরতা বলতে যা বুঝি তাতে চণ্ডীদাসের তীব্র প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় , আবার রূপবিলাস ও মণ্ডনকলার বিচারে গোবিন্দদাস শ্রেষ্ট । কিন্তু রূপ রসের যথার্থ সংমিশ্রণ ও কাব্য মূর্তি সং গঠনে জ্ঞানদাস বিনা তা দুর্লভ ।
কিছু বৈশিষ্ট্য জ্ঞানদাস

গভীর আত্ম উপলব্ধির বহির্প্রকাশ কূলপ্লাবী উন্মাদনা সাধকোচিত ভাবাঙ্গ সৃজনের অক্ষমতা ভাব ছাড়া বহু ক্ষেত্রে অনুপম প্রকাশভঙ্গির অনুশীলন তুলনা করলে , কথকের ব্যখ্যায় রবীন্দ্র “ইন্দ্রাণী “ রূপরের মতই জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভা “ আপনার মধ্যে একটা প্রবল বেগ এবং প্রখর জ্বালা একটি সহজ শক্তির দ্বারা অটল গাম্ভীর্যপাশে অতি অনায়াসে বাঁধিয়া রাখিয়াছে । বিদ্যুৎ তাহার মুখে চোখে এবং সর্বাঙ্গ নিত্যকাল নিস্তব্ধ হইয়া রাখিয়াছে । “

কবি বৈশিষ্ট্য

লিরিক কবি হিসাবে তাঁর সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য গুলি হল নিম্নরূপ ঃ
• সুতীব্র রসনাভূতি
• মন্ময়তা প্রধান বৈশিষ্ট্য বহুল আলেপন
• আপনাকে প্রকাশ করার ভঙ্গি স্রষ্টার হৃদয়বাসনার রজ্ঞিত হয়।
• ভাবের কথা ও হৃদয়ের কথা সেখানে বস্তুবিদ্ধ রূপ পেয়েছে রূপ তন্ময় বিভাবাদি হৃদয় ভাবে ।
• রূপকল্প ভাব তাঁর স্ব ভাবনার ফসল
• জ্ঞান্দাসের মধ্যে ভক্তিপ্রাণতা আছে কিন্তু তথাপি আত্মনিবেদন চমৎকার ।
• এককথায় তিনি বুঝতএন কোথায় থামা উচিৎ কোথায় পাঠকের ভাবকুলের নিজস্বতা সম্পূর্ণতা দান করতে সক্ষ্মম, তাই সমাপ্তিতা তিনিই করে নেন ।

স্বতন্ত্র শক্তিরূপের পূর্বরাগের আরম্ভন পর্বে
“আলো মুঞি জানো না সই জানো না
জানো না গো জানো না ।“
এক রোমান্টিক কবির কন্ঠে স্পন্দনমান হৃদয়ের উচ্ছ্বাস অকারণ অনুনয়ের সুরে বেযে ওঠে । সাহিত্য রত্ন শ্রী হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এর সম্পাদিত “বৈষ্ণব পদাবলী “ হতে গৃহীত জ্ঞান দাসের পদ সমূহ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল –
“শ্রী গৌরাচন্দ্র “
“শচীগর্ভসিন্ধু মাঝে গৌরঙ্গরতন রাজে
প্রকট হইলা অবনীতে “
“হেমবরণ বর সুন্দর বিগ্রহ
সুরতরুবর পরকাশ”

কাঞ্চন বরণ গৌর তনু মোহন
প্রেমে আকুল দুই নয়ন ঝরে ।

শ্রী শ্রী গৌরনিত্যনন্দ

“কলধৌত কলেবর গৌর তনু
তছু সঙ্গ ও রঙ্গ নিতাই জনু “

শ্রী শ্রী নিত্যানন্দ

“যে জন গৌরাঙ্গ ভজিতে চায় ।
সে শরণ লঊক নিতাইচাঁদের
অরুণ দুখানি পায় ।

শ্রী রাধার প্রতি উক্তি

এ তোর বালিকা চান্দের কলিকা
দেখিয়া জুড়ায় আঁখি “

শ্রীরাধার পূর্বরাগ
“নিতি নিতি রাই যমুনা সিনানে
না শুনি না দেখি তার পদ কোন দিনে “

“অভিসার”
কানুঅনুরাগে হৃদয় ভেল কাতর
রহই না পারি গেহে “

বসন্তাভিসার
“নব মধুমাস কুসুমময় গন্ধ
রজনি উজোরল গগনহি চন্দখ্যা

আক্ষেপানুরাগ
অরুন উদয় কালে ব্রজশিশু আসি মিলে
বিপিনে পয়ান প্রাণনাথ

এইরূপেই জীবনের প্রতিক্ষেপে পদ বিবিধ তালের আলোড়নে বিশিষ্টতা লাভ করেছে ।

শ্রীরাধা কৃষ্ণ পরস্পর উক্তি
“তুয়া অনুরাগে হাম নিমগম হইলাম
তুয়া অনুরাগে হাম গোলোক ছাড়িলাম “

মূল্যায়ন

রোমান্টিকতার আলোকে বিশদে নিগূঢ় আবেগ আর ব্যক্তি সার্থকতার মোক্ষধামতুল্য আলাপন চিরন্তন তৃষ্ণাধারায় চিরদিনই অনধিকাম্য । তাঁর ধারায় বৈষ্ণবের জয় কারণ বৃন্দবন শুধু কল্পনায় নয় , হয়ত ধ্যানে নিত্যেও বটে । নিত্যধারায় রাধিকা ও কৃষ্ণ। তিনি তাঁর স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন ঘটনা সংস্থান সৃষ্টির মৌলিকতায় ও রূপ বিহ্বলতায় । “রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর , “মনের মরম কথা” “এ ঘোর রজনী মেঘের জটা” পদসমূহ চিরস্মরণীয়। বৈষ্ণব কবি তাই ভক্ত ও সাধক রূপে অপ্রাকৃত বৃন্দাবনের অস্তিত্বের দৃঢ় বিশ্বাস রেখে , ঐ বৃন্দবনের বেষ্টনীর মধ্যে লীলারত রাধাকৃষ্ণ হৃদয়ের নিজের প্রেমস্বভাবকে দর্শন করে কবি যাতনার উপশম চেয়েছেন । এখানেই কবি জ্ঞানদাস সর্বাপেক্ষা সেই কবি ।

তথ্যসূত্র
I. সাহিত্যের ইতিহাস (বাংলা )
II. মধ্যযগের কবি ও কাব্য
III. বাংলা সংসদের সাহিত্য সঙ্গী
IV. বৈষ্ণব পদাবলী সম্পূর্ণ
V. মধ্যযুগ পর্ব সহায়ক

আলোচক – প্রিয়াংকা সরকার, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *