রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসাময়িক পত্রিকা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – কবি যখন সম্পাদক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – এই আলোচনায় কবির পত্রিকা-সম্পাদক হিসেবে নানা ভূমিকার কথা আলোচিত হয়েছে। কবি নানা সময় নানা পত্রিকার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের এই আলোচনায় কবি রবীন্দ্রনাথের পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে ভূমিকা সম্পর্কিত নানা তথ্য প্রদান করা হয়েছে। আশা করি পাঠক পাঠিকা উপকৃত হবেন।

ভূমিকা

ঠাকুর বাড়ির সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাল্য থেকেই বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে গভীর একাত্মতা অনুভব করতেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’,  যোগেন্দ্রনাথ ঘোষের ‘অবোধবন্ধু’ (পরে বিহারীলাল চক্রবর্তী এর সম্পাদক হন), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’, অক্ষয়কুমার দত্তের ‘তত্ত্ববোধিনী’,  যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের ‘আর্য্যদর্শন’,  শ্রীকৃষ্ণ দাসের ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ — প্রভৃতি পত্রিকার দ্বারা শৈশব ও কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ আজীবন বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে নানা ভাবে যুক্ত থেকেছেন। যে সমস্ত পত্রিকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরাসরি সম্পাদনা করেছিলেন নীচে সে গুলির বর্ণনা দেওয়া হল।

পত্রিকা ও রবীন্দ্রনাথ

‘সাধনা’ :– ১২৯৮ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে ঠাকুর বাড়ির তরুণদের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘সাধনা’ পত্রিকা। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পত্রিকাটির জন্মলগ্ন থেকেই সুধীন্দ্রনাথকে নানা ভাবে সাহায্য করেন তাঁর প্রিয় ‘রবিকা’।

‘সাধনা’ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ — ১৩০১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাধনা’ পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহন করেন। ‘সাধনা’ পত্রিকাটির সম্পাদনার মাধ্যমেই পত্রিকা-সম্পাদক রূপে রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ ‘ছিন্নপত্রাবলী’ – তে ‘সাধনা’ পত্রিকাটির সম্বন্ধে লিখেছেন —

‘সাধনা আমার হাতের কুঠারের মতো, আমাদের দেশের বৃহৎ সামাজিক অরণ্য ছেদন করবার জন্যে একে আমি ফেলে রেখে মরচে পড়তে দেব না — এ’কে আমি বরাবর হাতে রেখে দেব। যদি আমি আরও আমার সহায়কারী পাই তো ভালোই, না পাই তো কাজেই আমাকে একলা খাটতে হবে।’

সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমল থেকেই পত্রিকাটি আর্থিক সংকটে ভুগছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তিনি মাসিক এই পত্রিকাটিকে ত্রৈমাসিক করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন অবস্থার উন্নতি ঘটাতে। কিন্তু সেই চেষ্টাও ফলপ্রসু হয়নি। ১৩০২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনাতে পত্রিকাটির ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক মাসের যে যুগ্ম সংকলনটি বেরোয় সেটিই এই পত্রিকাটির শেষ সংখ্যা।

‘ভারতী’

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’ – এর আদর্শকে সামনে রেখে ১২৮৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে ঠাকুর বাড়ি থেকে ‘ভারতী’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষার উন্নতি ও সেবার উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা এই পত্রিকাটি অর্ধ শতাব্দী ধরে সচল থেকেছে। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা পর্যন্ত এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। ‘ভারতী’ – র প্রথম সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে এই প্রকাশের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখেছেন —

‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্পাদক না হলেও প্রকৃতপক্ষে ভারতী জ্যোতিবাবুরই মানসকন্যা।’
‘…বড়দাদাকে সম্পাদক করিয়া জ্যোতিদাদা ভারতী পত্রিকা বাহির করিবার সংকল্প করিলেন। এই আর-একটা আমাদের উত্তেজনার বিষয় হইল। আমার বয়স তখন ঠিক ষোলো। কিন্তু আমি ভারতীর সম্পাদক চক্রের বাহিরে ছিলাম না।’

‘ভারতী’ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– ১৩০৫ বঙ্গাব্দে (১২৯৮ খ্রিঃ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক হন। বলাবাহুল্য এই পত্রিকা সম্পাদনা করার অভিজ্ঞতা তাঁর মোটেই সুখকর হয়নি। একবছর পরেই ‘ললাটের ঘর্ম্ম মুছিয়া’ সম্পাদকের পদ থেকে বিদায় নেন। ‘সম্পাদকের বিদায় গ্রহণ’ কালে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন —

‘আমাদের দেশের সম্পাদকদের পত্রসম্পাদন হালগোরুর দুধ দেওয়ার মত,— সমস্ত দিন ক্ষেতের কাজে খাটিয়া কৃশ প্রাণের রসাবশেষটুকুতে প্রচুর পরিমাণে জল মিশাইয়া যোগান দিতে হয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পাদক জীবনের প্রথমে ‘সাধনা’-কে নিজের মতো করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেও, শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। ‘ভারতী’ – দায়িত্ব হাতে পেয়ে ‘সাধনা’রই পুনর্জন্ম দিলেন। এতদিনের প্রচলিত ধারনা ভেঙে তিনি সমস্ত বিভাগের রূপান্তর ঘটালেন। ‘গ্রন্থ সমালোচনা’ ; ‘প্রসঙ্গ কথা’ ; ‘সাময়িক সাহিত্য’ প্রভৃতি বিভাগ নিয়মিত ভাবে লিখতে শুরু করেন। ‘ভারতী’ পত্রিকার মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ সমকালীন রাজনৈতিক প্রসঙ্গে নিজ মতামত ব্যক্ত করেন। এই কারনে তিনি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লিখেছিলেন —

‘সাধনা আর বাহির করিবার প্রয়োজন থাকিবে না। ভারতীর দ্বারাই আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করিতে হইবে।’

আরো পড়ুন

‘নবপর্য্যায় বঙ্গদর্শন’ :– ১২৭৯ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ (১৮৭২ খ্রিঃ) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র এই পত্রিকাটির মাধ্যমে স্বাজাত্যপ্রীতি, জাতীয়তাবোধকে বাস্তবে রূপদান করেন। এই পত্রিকাটি বিশুদ্ধ সাহিত্য রসের দ্বারা সমকালীন বাঙালির প্রণের ক্ষুধা ও হৃদয়ের পিপাসা মেটাতে সমর্থ হয়েছিল। কৈশোর থেকেই রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকাটির প্রতি বিশেষভাবে আকর্ষণ অনুভব করতেন। বঙ্কিমচন্দ্র চার বছর (১৮৭২-৭৬) ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনা করার পর পত্রিকাটি ভার দেন জ্যেঠ ভ্রাতা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। তার পর শ্রীশচন্দ্র এর ভার নেন। কিন্তু এদের সম্পাদনাতে পত্রিকাটি বঙ্কিমী গুনমানকে ছুঁতে পারছিল না। তাই শ্রীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বার বার ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনার জন্য অনুরোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ ইতিপূর্বে ‘সাধনা’ ও ‘ভারতী’ সম্পাদনা করেছেন সেই অভিজ্ঞতা তাঁর মোটেও সুখকর হয়নি। তখন থেকেই তিনি নিজেকে এর থেকে দূরে দূরে রাখতেন।

‘নবপর্য্যায় বঙ্গদর্শন’ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর — এর পর তিনি এই গুরুভার গ্রহণে সম্মত হলেন। ১৩০৮ বঙ্গাব্দে তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক হন। ১৩১২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। প্রথমেই ‘বঙ্গদর্শন’ নামের সঙ্গে যোগ করেন নবপর্য্যায় শব্দটি। ‘নবপর্য্যায় বঙ্গদর্শন’ -এ রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের পাঠকদের রসপিপাসা মেটানোর দায়িত্ব নিলেন। প্রবন্ধের পাশাপাশি প্রকাশিত হতে শুরু করল নতুন যুগের উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিকতার আলোকে নর-নারীর ‘আঁতের কথা’ শোনালেন। তৎকালীন রক্ষণশীল পন্থিরা রবীন্দ্রনাথের এই প্রয়াসকে ভালোভাবে নেননি। প্রশংসা তো দূরের কথা অনবরত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের খোঁচা বর্ষিত হতে থাকে তাঁর প্রতি। ‘সাহিত্য’ পত্রিকা ১৩০৮ বঙ্গাব্দে ‘চোখের বালি’ সম্পর্কে লেখে —

‘রবিবাবু এতবড় লম্বা ও এমনতর কুৎসিত উপন্যাসে হাত দিয়ে একেবারেই ভাল করেন নাই।…… রবিবাবুর এই বই অতঃপর ‘বঙ্গদর্শনে’ বাহির হওয়া বন্ধ হইলেই,বোধহয় ভাল হয়। কারণ তাঁহার এই ‘চোখের বালি’ বঙ্কিমবাবুরই হউক বা আর যাহারই হউক, বঙ্গদর্শনের মুখে চুনকালি মাখিয়া দিতেছে।’

রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসটিও ‘নবপর্য্যায় বঙ্গদর্শন’-এ বেরিয়ে ছিল। এই উপন্যাসটি সম্পর্কেও কার্তিক ১৩১১ বঙ্গাব্দে ‘সাহিত্য’ পত্রিকা মন্তব্য করেছিল —

‘সম্পাদকের নৌকাডুবি এখনও চলিতেছে; ভক্ত পাঠকগণ নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া ভরাডুবির প্রতীক্ষা করিতেছেন।’

‘সাহিত্য’ পত্রিকা যাই বলুক না কেন ‘নবপর্য্যায় বঙ্গদর্শন’ রবীন্দ্রনাথের হাতে প্রাণ পেয়েছিল। একদিকে ভারতবর্ষের আদর্শকে তুলে ধরা, অন্যদিকে সমকালীন ইংরেজ শাসন সম্পর্কে সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছে পত্রিকাটির পাতায়। ‘সাধনা’ ও ‘ভারতী’ সম্পাদনা কালে রবীন্দ্রনাথকে যেমন অধিকাংশ রেখা নিজেকেই লিখতে হয়েছিল, এখানে তেমনটা ঘটেনি। এখানে রবীন্দ্রনাথ সগযোগী লেখক হিসাবে পেয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দসুন্দর ত্রিবেদী, অক্ষয়কুমার মৈত্র, দীনেশচন্দ্র সেন, জগদানন্দ রায়, সখারাম গণেশ দেউস্কর এর মতো লেখকদের।

‘ভাণ্ডার’

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সরলা দেবী (রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী) স্বদেশী জিনিশপত্র বিক্রির জন্য ‘লক্ষীর ভাণ্ডার’ নামে একটি দোকান খোলেন। প্রধানত মেয়েদের সাহায্যের জন্য দোকানটি খোলা হলেও এর মূলে ছিল স্বদেশী ভাবের প্রেরণা। এই ভাবকে সঙ্গী করে কেদারনাথ দাশগুপ্ত এখান থেকে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। দোকানের নামানুসারে পত্রিকাটির নাম রাখা হয় ‘ভাণ্ডার’। কেদারনাথ রবীন্দ্রনাথকে পত্রিকাটি সম্পাদনার জন্য অনুরোধ জানান। পত্রিকাটির আদর্শের কারনে রবীন্দ্রনাথ রাজি হন।

‘ভাণ্ডার’ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ — ১৩১২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ‘ভাণ্ডার’ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ (বৈশাখ, ১৩১২ বঙ্গাব্দ ‘ভাণ্ডার’) -এ লিখলেন —

‘আমি এই কাগজ-সম্পাদনের কাজে ধরা দিলাম কেন— একথা যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন,তবে আমার জবাব এই যে, ব্যাধের বাঁশি শুনিয়া হরিণ যে কারণে ধরা দেয়,আমারও সেই একই কারণ। অর্থাৎ তাহা কৌতুহল, আর কিছুই নহে।….আমি অনেক সম্পাদকি করিয়াছি, আমাকে এ কথা কবুল করিতে হইবে যে আমাদের দেশে বড় বড় কাগজে বড় বড় প্রবন্ধ অধিকাংশই বানাইয়া তোলা। সে সকল লেখার তাগিদ অন্তরের মধ্যে নাই’

দেশ ও জাতির সমস্ত রকম হিত সাধনের উদ্দেশ্যেই ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকার প্রকাশ। সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ জনগণকে সজাগ রাখতে চেয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক,রাষ্ট্রনৈতিক অসংগতি সম্পর্কে। ‘ভাণ্ডার’ টিকে ছিল আড়াই বছর, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ দু’বছর এর সম্পাদক ছিলেন। এই সময়কালে তিনি রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও কিছু দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা ছাড়া কোনোরকম গল্প-উপন্যাস বা লঘু রচনা প্রকাশিত হতে দেননি। দু’বছরেরর মাথায় পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ‘ভাণ্ডার’-এর মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এলে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদকের দায়িত্ব ত্যাগ করেন। ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের অজস্র স্বদেশী গান বেরিয়েছিল। প্রথম বছরে (১৩১২ বঙ্গাব্দ) পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংখ্যায় তিনি লিখেছেন –

“এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে
জয় মা বলে ভাসা তরী”

এই পত্রিকাতেই তিনি বাউলের সুরে লিখলেন ‘একা’ নামের বিখ্যাত গানটি। সকল বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে ব্যক্তিমানুষকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে দৃপ্ত কন্ঠে বললেন –

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চল রে।”

সাময়িক পত্রিকায় ‘উত্তর-প্রত্যুত্তর’ বা ‘প্রশ্ন-উত্তর’ বিভাগের দ্বারা পাঠক ও লেখক উভয় সম্প্রদায়কে যে উজ্জীবিত করা যায় ‘সাধনা’ ও ‘ভারতী’ পত্রিকার অভিজ্ঞতার সূত্রে রবীন্দ্রনাথ তা বুঝেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ‘ভাণ্ডার’-এর প্রশ্নোত্তর বিভাগটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। এই প্রশ্নোত্তরের বিষয় বেশিরভাগই ছিল সমকালীন কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে। এভাবে কবিতা,গান,প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনের ভাষারূপ দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকা। রাজনৈতিক আন্দোলনে শিক্ষিত শ্রেণীর সঙ্গে আপামর জনসাধারণের দূরত্বমোচনের প্রয়াস করেছিলেন ‘ভাণ্ডার’ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা

রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্ম ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্বরঞ্জিনী’ সভা তৈরি করেন। পরে ঐ সভার নাম হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’ সভা। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট ‘তত্ত্ববোধিনী’ সভার মুখপত্র রূপে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায়, অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়। এরপর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অয্যোধ্যানাথ পাকড়াশী,হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন,দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর — ১৩১৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পত্রিকার সম্পাদক হন। চার বছর তিনি এই পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। এ সময় রবীন্দ্রনাথ পত্রিকার বিষয় ও লেখক উভয় বিষয়ে পরিবর্তন আনলেন। সম্পাদকরূপে নিজে তো লিখলেনই, লিখিয়ে নিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজিতকুমার চক্রবর্তী,ক্ষিতিমোহন সেন,জগদানন্দ রায়দের মতো লেখকদের দিয়ে। ব্রাহ্মধর্মের আলোচনার পাশাপাশি যোগ করলেন সংস্কারমূলক তর্ক-বিতর্ক। গুরুত্ব পেলো সাহিত্য। প্রবন্ধের বিষয় হল – সমাজ,সাহিত্য,শিক্ষা,বিজ্ঞান,সমকালীন সংবাদ।

‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার মধ্যো দিয়ে তিনি পত্রিকার সাথে শান্তিনিকেতনের যোগসূত্র গড়ে তোলেন। এই উদ্দেশ্যে নতুন বিভাগ খুলেছিলেন ‘ব্রহ্ম বিদ্যালয়/আশ্রম কথা’। এই সময় বিশ্বভারতীতে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক দানা বাঁধে। অব্রাহ্মণ শিক্ষকদের ব্রাহ্মণ ছাত্ররা প্রণাম করবে কি করবে না –এই মর্মে নানান কথা উঠে আসে। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায় প্রণামের সপক্ষে তাঁর মতামত ঘোষনা করেন এবং তা ছাপা হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায়।

পত্রিকাটি যাতে শুধুমাত্র ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্রই হয়ে না ওঠে এজন্য রবীন্দ্রনাথের প্রজেষ্টার অন্ত ছিলনা। তিনি নিজে ‘মনুষ্যত্বের সাধনা’ ; ‘আত্মপরিচয়’ ; ‘বিলাতের পত্র’ – এর মতো প্রবন্ধ লিখেছেন সে সময়। চিঠি,অভিভাষন,গান, কবিতা রচনা করেছেন প্রায় প্রত্যেকটি সংখ্যার জন্য। এই পত্রিকাতেই আমাদের জাতীয় সংগীত ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে’ “ভারত-বিধাতা” নামে মুদ্রিত হয়। সমস্ত দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী নতুন গতি লাভ করে। চার বছরের সম্পাদনায় রবীন্দ্রনাথ ‘তত্ত্ববোধিনী’-কে ধর্মের বেষ্টনী ছাড়িয়ে সমকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে দিতে পেরেছিলেন।

‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’

(VISVA-BHARATI QUARTERLY) পত্রিকা :– বিশ্বভারতীর সঙ্গে দেশ-বিদেশের সম্বন্ধ রক্ষার তাগিদে প্রকাশিত হয় ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’ পত্রিকা। ত্রৈমাসিক এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৮২ পৃষ্ঠা আয়তনের প্রথম সংখ্যাটিতে মোট ৯ টি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নিজের রচনা ছিল ৫ টি। সেগুলি হল
1. ‘Visva-Bharati’
2. ‘My nest weary wings fluttered(Poem)
3. ‘Tumultuous years being their voice (poem)
4. ‘A vision of India’s history’
5. ‘Creative Unity’

প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর নানান কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব তুলে দেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদনার ভার গ্রহন করলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শমতোই পত্রিকাটি পরিচালনা করতে থাকেন।

এছাড়াও  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘হিতবাদী’ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন।

একনজরে সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনের সময়কাল

১. ‘সাধনা’– অগ্রহায়ণ,১৩০১ বঙ্গাব্দ থেকে ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক ১৩০২ বঙ্গাব্দ।
২. ‘ভারতী’ — ১৩০৫ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩০৬ বঙ্গাব্দ।
৩. ‘নবপর্য্যায় বঙ্গদর্শন — ১৩০৮ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩১২ বঙ্গাব্দ।
৪. ‘ভাণ্ডার’ — বৈশাখ ১৩১২ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩১৪ বঙ্গাব্দ।
৫. ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ — ১৩১৮ বঙ্গাব্দ থেকে…………………. ।
৬. ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’ — ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল সংখ্যাটি। (বৈশাখ, ১৩৩০ বঙ্গাব্দ)।

তথ্যসূত্র

১. “পত্রিকার জগতে রবীন্দ্রনাথ”
— প্রবীরকুমার বৈদ্য।
২. “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস” আধুনিক যুগ (১৮০০-১৯৬০)
— ড. দেবেশ কুমার আচার্য।
৩. “আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস”
— তপনকুমার চট্টোপাধ্যায়।
৪. “দুই শতকের বাংলা সংবাদ সাময়িক পত্র”
— স্বপন বসু, মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত।

আলোচক – সুভাশিষ ঘোষ, বাংলা ছাত্র, বেথুয়াডহরী, নদীয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *