পাঁচমিশালী

বাংলা গানের ধারায় সলিল চৌধুরী

আধুনিক বাংলা গানের সুরকার, সুরস্রষ্টা ও গণসংগীতের প্রণেতা সলিল চৌধুরী র নাম বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। তিনি মূলত বাংলা, হিন্দি এবং মালয়ালাম চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। এই প্রচ্ছদে সেই বিখ্যাত শিল্পী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

জন্ম ও বংশ পরিচয়

সলিল চৌধুরী দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের গাজিপুরে এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী, আসামের লতাবাড়ি চা বাগানে ডাক্তারি করতেন। বাবার কাছেই সলিল চৌধুরীর সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি। পিতৃব্য নিখিল চৌধুরীর কাছেও সংগীতের তালিম গ্রহণ করেন তিনি। মূলত নিখিল চৌধুরীর ঐক্যবাদন দল ‘মিলন পরিষদ’-এর মাধ্যমেই গানের জগতে শৈশবেই সম্পৃক্তি।

শিক্ষা ও কর্মজীবন 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুভাষগ্রামে, (পুরাতন নাম কোদালিয়া) মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন। হারিনাভি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং উচ্চ মাধ্যমিক (আইএসসি) পাশ করেন। এরপর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। কর্মজীবন প্রারম্ভিক প্রভাব ছোটবেলা থেকেই তিনি তার পিতার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন। তাঁর পিতা চা বাগানের কুলি এবং স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের সাথে মঞ্চ নাটকের জন্য সুখ্যাতি সম্পন্ন ছিলেন।

তিনি কলকাতায় অবস্থিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এ সময়েই তার সঙ্গীত জ্ঞানে পরিপক্কতা লাভের পাশাপাশি দ্রুত তার রাজনৈতিক ধারণা জন্মায়। তিনি দারুণ মেধা সম্পন্ন ছিলেন। ১৯৪৪ সালে যখন তরুণ সলিল তাঁর স্নাতক পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন, তখনই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ-এ (Indian Peoples Theater Association) যোগ দেন। এ সময় তিনি গান লিখতে এবং এর জন্য সুর করা শুরু করেন।

অবদান

আধুনিক বাংলা গানের সুরস্রষ্টা ও গণসংগীতের প্রণেতা সলিল চৌধুরী গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক জুড়ে একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ছিলেন। কবিতা, গান, সুর দেয়া- সব ক্ষেত্রেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। বিটোভেনের সিম্ফনি, মোৎসার্টের জি-মাইনর ফর্টিএথ সিম্ফনি, ই-মাইনর, জি-মাইনর কর্ডের প্রতি তার অনুরাগ থেকেই বাংলা ও হিন্দি ভাষায় উপহার দিয়েছেন অনেক ভালোলাগার গান ও সুর।

সঙ্গীত পরিচালনা

সলিল চৌধুরী বাংলা, হিন্দি এবং মালয়ালাম চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। এছাড়াও তিনি একজন কবি এবং চিত্রনাট্যকার। তার সঙ্গীত প্রতিভা ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। তিনি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমন বাঁশি, পিয়ানো, এসরাজ ইত্যাদি বাজাতে জানতেন। তার মৌলিক কবিতাগুলোর জন্য তিনি ব্যাপকভাবে নন্দিত এবং প্রশংসিত। সলিল চৌধুরী মানুষের জন্য রাজনীতি করতেন। তার রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশের গোড়া থেকেই সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন। তেভাগা আন্দোলন শুরুর বেশ আগেই ১৯৩৯ সালে তিনি কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। নদীর বানে কৃষকের দুরবস্থায় তিনি গান লিখলেন, ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে, ‘কৃষক সেনাদের মুষ্টি তোলে আকাশে’।

পঞ্চাশের মণ্বন্তরে তিনি লিখে যান একের পর এক গান, ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’,‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’। তার লেখা গণসংগীত অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে ছাত্র-মজুর-কৃষকসহ সব অধিকার বঞ্চিতদের। তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারাণের নাতজামাই’ গল্প নিয়ে সলিল চৌধুরী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন কার্তিক পাইক। সেখানে তিনি নিজেই সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তেভাগা ও কৃষক জীবন নিয়ে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল ‘ছিন্নমূল’, ‘দো বিঘা জমিন’ (কাহিনীকার সলিল চৌধুরী), ‘রিকসাওয়ালা’ ও ‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’।

আরো তথ্য

সাংগীতিক জ্ঞানে ও ক্ষমতায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তখন গণনাট্য সঙ্ঘের উচ্চাসনে। সলিল চৌধুরী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সান্নিধ্যে কতখানি উপকৃত হয়েছিলেন সে-কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে গেছেন। তবু যে অসাধারণ ক্ষমতা থাকলে ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ বা ‘লা পালুমা’র- মত সর্বাঙ্গসুন্দর গান সৃষ্টি করা যায় তা ছিল সলিল চৌধুরীর। এই গানটির বাঁধন, মনমাতানো শব্দের প্রয়োগ, দেশজ সুরের আবেদন ও গ্রামীণ ছবি ফোটাবার সাফল্য- সব মিলিয়ে আজো দেশবাসীর মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এ গান ‘কোয়ানটানামেরা’-র মত চিরআদরণীয় হবার কথা। বড় আনন্দ হয় যখন এই গানটি অ-কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে ও গাওয়া হয়। গানের উৎকর্ষ গানটিকে পার্টির গন্ডির বাইরে নিয়ে গেছে।

তেভাগা আন্দোলনের পত্তন কৃষকদের হাতে। এই গানে তাদের লক্ষ্যে স্থিত থাকতে আহ্বান করা হয়েছে। ‘কাস্তেটা দাও শান তো’- এর মত ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’ দেবার কথা অন্য গীতিকারেরাও লিখেছেন। সাদা হাতির কালা মাহুত কথাগুলো অত্যাচারী ব্রিটিশ প্রশাসক ও তৎকালীন রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট শোষকদের চিত্র অপরূপ দক্ষতায় ফোটানো হয়েছে। হাতির উল্লেখ ডুয়ার্সের চা-বাগান অঞ্চলের অত্যাচারকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। রেবা রায় চৌধুরী ইউরোপে মাদার্স কনভেনশনে-এগানটি গেয়েছিলেন। সেখানে ‘হেই সামালো’ গানটি গেয়ে মাত করে দিয়েছিলেন। তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘হেই সামালো।’

গান

তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিকায় গণনাট্য সঙ্ঘের অন্যান্য সংগীতকারেরা অনেক উচ্চমানের গান রচনা করেছিলেন। সলিল চৌধুরীর পাশাপাশি অন্যান্য কৃতী সংগীত রচয়িতাদের কিছু গান হল:

‘কাস্তেটা দিও জোরে শান’- কথা ও সুরা হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ‘তোর মরা গাঙে এবার আইলো এবার বান’- কথা ও সুর হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ‘বাঁচব বাঁচব রে আমরা’- কথা ও সুর হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ‘আর কতকাল বল কতকাল সইব এ মৃত্যু অপমান’- কথা ও সুর বিনয় রায়, ‘হোই রে হোই আবার বুঝি মরণ আসেরে ঘরে ঘরে’- কথা ও সুর অনিল ঘোষ, ‘শুনেন যত দেশবাসী শুনেন ভাই গরীব চাষী’- কথা ও সুর নিবারণ প-িত, ‘শোনো কাকদ্বীপ রে’- কথা ও সুর সাধন গুহ, ‘ধন্য তুমি জন্মভূমি’- কথা ভাস্কর বসু, সুর নির্মলেন্দু চৌধুরী, ‘হুঁশিয়ার হও সাথী কিষাণ মজদুর’- কথা ও সুর বাসুদের দাশগুপ্ত, ‘সম্মুখে ফাঁকা জায়গায় মোটরগাড়ি থুইয়া’ ও ‘রণে বাজিল রে, রণ পায় রণডংকা সাজিল রে’- কালী সরকারের দু’টি জংগান, ‘শোন গো দূরের পথিক’- কথা প্রবীর মজুমদার, সুর কৃষ্ণা বসু, ‘ঘুমাস না আর খোকা আবার বর্গি এল দেশে’- কথা অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘গুরু গুরু গুরু মেঘের বাদল বাজে’- কথা অনল চট্টোপাধ্যায়, সুর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়,’ ‘অনেক ভুলের মাশুল তো ভাই দিলাম জীবন ভরে’- কথা অনল চট্টোপাধ্যায়, সুর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। গণসংগীত জাতীয়তাবাদী বা জনগণসংগীত ভাবার যথেষ্ট অবকাশ থাকলেও সেই মান পায়নি, কারণ গণসংগীত ছিল গণনাট্য সঙ্ঘের গান। গণনাট্য সংঘ পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি চালিত সেটা না মেনে উপায় নেই।

তেভাগা ও সলিল চৌধুরী

সলিল চৌধুরীর তেভাগা আন্দোলনের গান রচিত হয়েছিল তাঁর গাঁয়ের বধূ ও অন্যান্য গণসংগীত গ্রামোফোন রেকর্ডে দেশবাসীর কাছে পৌঁছবার কিছু আগে। সলিল চৌধুরীর জনপ্রিয়তা তখনও তুঙ্গে ওঠেনি। আন্দোলনের সময়ে তাঁর যে সব গান ব্যঙ্গরসে ভরা ছিল সেগুলো গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পীরা মনে রাখলেও জনসাধারণ ক্রমশ ভুলে যায়। সলিল চৌধুরী তখন তেভাগা আন্দোলনের গান ‘আয়রে ও আয়রে, ভাইরে ও ভাইরে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুকণ্ঠে রেকর্ড করান। সলিল চৌধুরীর গণসংগীত তাই অন্য রচয়িতাদের গানের মত লুপ্ত হতে পারে না। দেশ স্বাধীন হবার আগে ব্রিটিশ সরকার এবং পরের কংগ্রেস সরকার গ্রামোফোন রেকর্ডে সলিল চৌধুরীর গণসংগীত প্রকাশ করবে না জেনেই তিনি গানের কথা অনেক মৃদু অর্থাৎ নিরর্থক করে তবেই রেকর্ড করিয়েছেন। আন্দোলনের জোরাল বক্তব্য ও ভাবমূর্তি এসব গানে পুরোপুরি ফোটেনি।

পুরস্কার

১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত দো বিঘা জমিন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। সলিল চৌধুরীর ছোট গল্প “রিকসাওয়ালা” অবলম্ভনে এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রটি তার কর্মজীবনকে নতুন মাত্রা যোগ করে যখন এটি প্রথমে ফিল্মফেয়ার সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়।

বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল দা ১৯৬৪ সালে চিম্মিন দিয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। চলচ্চিত্র সফলতা পাক বা না পাক সলিলদার মালয়ালাম গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

তিনি প্রায় ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪০টির বেশি বাংলা চলচ্চিত্র, প্রায় ২৬টি মালয়ালাম চলচ্চিত্র, এবং বেশ কিছু মারাঠী, তামিল, তেলেগু , কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা মূলত ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। আধুনিক বাংলা গানের সুরস্রষ্টা ও গণসংগীতের প্রণেতা হিসেবে তাঁর অবদান অপরিসীম।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট ও দ্বাদশ শ্রেণির বিভিন্ন রেফারেন্স বই।

আলোচক – কুতুব আলী, রায়গঞ্জ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *