পাঁচমিশালী

মান্না দে – হৃদয়স্পর্শী এক গায়ক

মান্না দে  আসল নাম প্রবোধ চন্দ্র ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সঙ্গীত শিল্পীদের একজন।  হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটিসহ অজস্র ভাষায় তিনি সঙ্গীত গেয়েছেন।

মান্না দে’র জন্ম ও বংশ পরিচয় 

মান্না দের প্রকৃত নাম প্রবোধ চন্দ্র দে হলেও সংগীত জগতে তিনি ‘মান্না দে’ নামেই পরিচিতি লাভ করেছিলেন।তাঁর পিতা পূর্ণচন্দ্র দে আর মাতা মহামায়া দে।তিনি ১৯১৯ সালের পয়লা মে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ১৯২০ ও ৩০-এর দশকের বিখ্যাত গায়ক ছিলেন।

মান্না দে’র শিক্ষা ও কর্মজীবন

পড়াশোনা কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ আর বিদ্যাসাগর কলেজে। মান্না দে’র গান শেখা শুরু তার কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে। কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন অন্ধ এবং ভ্রাতুষ্পুত্র মান্না দে ছিলেন একাধারে তার শিষ্য ও সহকারী।
উস্তাদ দবির খানের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে, যখন সিনেমায় প্লেব্যাক গাইছেন, তখনও উস্তাদ আমান আলি খান ও উস্তাদ রহমান খানের কাছে গান শিখেছেন। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সঙ্গে গান গাওয়ার জন্য মান্না দে মুম্বইতে পাড়ি দেন ১৯৪২ সালে। কিছুকাল পরই সিনেসায় প্লেব্যাকের সুযোগ পান। ‘তামান্না’ ছবিতে সুরাইয়ার সাথে দ্বৈতকণ্ঠে ‘জাগো এয় ঊষা’ গানটি প্লেব্যাকে তার প্রথম গান। তবে হিন্দি সিনেমায় তার প্রথম একক হিট গান ১৯৪৩ সালে ‘উপর গগন বিশাল’। শচীন দেব বর্মণ এবং অন্যন্য সঙ্গীত পরিচালকদের সুরে ১৯৪০, ৫০ ও ৬০-এর দশকে প্রচুর কালজয়ী সিনেমার গান উপহার দিয়েছেন তিনি।১৯৫৩ সালে ‘কতদূরে আর নিয়ে যাবে বলো’ গানটি তার রেকর্ড করা প্রথম বাংলা গান। ১৯৬০-এর দশক থেকে বাংলা সিনেমায় প্লেব্যাকেও তিনি ছিলেন অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কণ্ঠশিল্পী।

মান্না দে’র প্রতিভা ও অবদান

বাংলা আর হিন্দী ছাড়াও অসমীয়া, মারাঠি, মালয়ালম, কন্নড় প্রভৃতি ভাষাতেও প্রচুর গান গেয়েছেন মান্না দে। আর সব ভাষাভাষী মানুষের কাছেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি।মোহাম্মদ রফি ,কিশোর কুমার, মুকেশের মতো তিনিও ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।১৯৫০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মশাল’ ছবিতে শচীন দেব বর্মণের গীত রচনায় মান্না দে ‘ওপার গগন বিশাল’ নামে একক গান গেয়েছিলেন। এ গানের কথা লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। ১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠি ছবিতে একই নামে এবং গল্পে ‘আমার ভূপালী’ শীর্ষক একটি গান করেন। এসবের মধ্য দিয়েই সংগীতাঙ্গনে নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় গায়ক গড়ে তোলেন। মান্না দে ভীমসেন জোসির সঙ্গে একটি জনপ্রিয় দ্বৈত গান ‘কেতকী গুলাব জুহি’তে কণ্ঠ দেন। এ ছাড়াও তিনি কিশোর কুমারের সঙ্গে আলাদা গোত্রের দ্বৈত গান হিসেবে ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহী তোরেঙ্গে (শোলে)’ এবং ‘এক চতুর নার (পদোসান)’ গেয়েছেন। এ ছাড়া মান্না দে শিল্পী ও গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ আরও বেশ কিছু গীতিকারের সঙ্গে বাংলা ছবিতে গান গেয়েছেন। দ্বৈত সংগীতে লতা মুঙ্গেশকরের সঙ্গে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ গান করেছেন। রবীন্দ্র সংগীতসহ প্রায় ৩৫০০ গান গেয়েছেন এ কিংবদন্তী শিল্পী। ১৯৫৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর দক্ষিণাঞ্চলের কেরালার মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে বিয়ে করেন মান্না দে। তাদের সংসারে শুরোমা (১৯৫৬) ও সুমিতা (১৯৫৮) নামে দুই কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। ২০১২ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে সুলোচনা মারা যান। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুম্বইয়ে কাটানোর পর মৃত্যুর আগে কয়েক বছর আগে বেঙ্গালুরুর কালিয়ানগর শহরে বসবাস করছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে বাংলা ভাষায় তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ খ্যাতিমান আনন্দ প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজিতে ‘মেমরিজ কাম এলাইভ’, হিন্দিতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠী ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে ভাষান্তর হয়। মান্না দের জীবনী নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’
নামে ২০০৮ সালে একটি তথ্যচিত্রও মুক্তি পায়।দীর্ঘ প্রায় ষাট বছরের সংগীত জীবনে অসামান্য অবদান।

মান্না দে’র  জনপ্রিয় গানসমূহ 

তার গাওয়া ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি এখনও মানুষের মুখে মুখে গীত হয়। মান্না দের অসংখ্য হিট গানের মধ্যে রয়েছে- কফি হাউসের সেই আড্ডা, সবাই তো সুখী হতে চায়, যদি কাগজে লিখ নাম, পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন, কতদিন দেখিনি তোমায়, এ কূলে আমি, কথা দাও, খুব জানতে ইচ্ছে করে, আমি সারারাত, এ নদী এমন নদী, মাঝরাতে ঘুম, এ আছি বেশ, এইরাত যদি, কি এমন কথা, ক’ফোঁটা চোখের জল, সে আমার ছোটবোন, দীপ ছিল শিখা ছিল, যদি হিমালয়-আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ, শাওন রাতে, আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে, স্বপ্নে বাজেগো বাঁশি, তীর ভাঙা ঢেউ, না না যেও না, তুমি আর ডেকো না, সুন্দরী গো দোহাই দোহাই। হিন্দী বেশ কিছু জনপ্রিয় গান রয়েছে মান্না দে’র গাওয়া। এগুলো হল- ইয়ারি হে ইমান মেরা ইয়ার মেরি জিন্দেগি, না মাক্সগু সোনা চান্দি, জিন্দেগি ক্যয়সি হে পাহেলি হায়, পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া, লাগা চুনরি মে দাগ, এ মেরি জোহরা জাবিন, চুনরি সামহাল গোরি, এক চতুর নার কারকে সিঙ্গার, ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোরেঙ্গে, মুড় মুড় কে না দেখ প্রভৃতি।

মান্না দে’র সম্মান ও স্বীকৃতি

দীর্ঘ প্রায় ষাট বছরের সংগীত জীবনে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ‘দাদা সাহেব ফালকে’ খেতাবসহ অসংখ্য খেতাব অর্জন করেন তিনি। এ ছাড়া, ২০০৪ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০০৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডি. লিট সম্মাননা লাভ করেন।

দেহান্তর
২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর ৯৪ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আলোচক – কুতুব আলী, রায়গঞ্জ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *