উপন্যাস ও ছোটগল্প

কথাসাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়

বাংলা সাহিত্যে যার রচনায় জীবন সম্পর্কে এক গভীর প্রত্যয় ধরা পড়েছে তিনি হলেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯ – ১৯৭৯)। প্রথমাবধিই তিনি ‘বনফুল’ নামে পরিচিত। পিতা সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের আদি নিবাস হুগলী হলেও বনফুলের জন্ম ও বড় হওয়া বিহারে।

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুল বিহারের এক বাঙালি চিকিৎসক পরিবারের সন্তান ছিলেন। নিজেও পরবর্তীকালে চিকিৎসা বিদ্যাকেই বেছে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে। মণিহারী, সাহেবগঞ্জ ও হাজারীবাগের পর কলকাতায় আসেন চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ নিতে। কিন্তু কলকাতায় আসার পর থেকে তিনি উপলব্ধি করেন, চিকিৎসা বিদ্যায় যুক্ত হলেও সাহিত্য হচ্ছে তাঁর প্রেম। তিনি মনোনিবেশ করতে শুরু করলেন সাহিত্য চর্চায়। যদিও তাঁর সাহিত্য চর্চার প্রেক্ষাপটে আছে তাঁর ছাত্রজীবনের বন্ধু পরিমল গোস্বামীর প্রেরণা। তাঁর প্রচেষ্টা ও প্রেরণাতেই বলাই চাঁদ কী কবিতা, কী গদ্য সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে পটুত্ব অর্জন করেন। বাংলা সাহিত্য ক্রমশ একজন শক্তিমান লেখককে পেতে শুরু করে।

সাহিত্যকর্ম 

বনফুলের লেখালেখি সেই ছোট থেকেই। বিদ্যালয় জীবনেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন কবিতা। তা ‘মালঞ্চ’ নামক এক পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়। এরপর ‘প্রবাসী’তে তাঁর কয়েকটি অনুবাদ কবিতা এবং মৌলিক কবিতাও প্রকাশিত হতে শুরু করে। ‘এই প্রবাসী’তেই প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘চোখ গেল’। সময়কাল ১৩২৯ বঙ্গাব্দ। ১৯৪০ খ্রিঃ প্রকাশ পায় তাঁর ‘চতুর্দশী’ কাব্য। তাঁর কবিতায় আছে ব্যঙ্গ। ১০৯টি কবিতা নিয়ে ১৯৫৮ খ্রিঃ ‘বনফুলের ব্যঙ্গকবিতা’ প্রকাশও পেয়েছিল।

কিন্তু বাঙালি সাহিত্য পাঠক তাকে চেনেন এক স্বভাবসিদ্ধ কথাসাহিত্যিক হিসেবে। অথচ কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রেই তিনি নিজের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী লিখেছেন “রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথের কালকে পেরিয়ে যেতে পারার এক সাবলীল প্রকাশ বনফুলের নানা রূপের ভুরি পরিমাণ রচনায়..।”
আসলে তাঁর উপন্যাস গল্পে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথা স্থান পেয়েছে। ‘কিছুক্ষণ’ (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ) উপন্যাসে কলকাতার ভেসে চলা জীবন অভিজ্ঞতার কথা আছে। তাঁর ৩ খণ্ডে সম্পূর্ণ ‘জঙ্গম’ (১৯৪৩) উপন্যাসে ব্যক্তিজীবন, জীবন অভিজ্ঞতা কিংবা জীবন বোধের পরিচয় বিধৃত হয়েছে। তাঁর ‘হাটেবাজারে’ (১৯৬১) উপন্যাসটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। মিথ পুরাকথা আছে ‘পিতামহ’ (১৩৬১ বঙ্গাব্দ) উপন্যাসে। আদিম মানবের ইতিহাস তথা তাঁর নৃতত্ত্ব ভাবনা বিধৃত হয়েছে ‘ডানা’ (১৯৪৮, ‘৫০) উপন্যাসটিতে।  তাঁর অন্যান্য উপন্যাসগুলি হল – তৃণখণ্ড (১৯৩৫), বৈতরিণী তীরে (১৯৩৬), রাত্রি (১৯৪১), অগ্নি (১৯৪৬), পক্ষীমিথুন (১৯৬৪), প্রথম গরল (১৯৭৪), অধিকলাল (১৯৬৯) ইত্যাদি।

বনফুলের ছোটগল্প গ্রন্থগুলি হল – বিন্দুবিসর্গ (১৯৪৪), তণ্বী (১৯৫২), ঊর্মিমালা (১৯৫৫), করবী (১৯৫৮), মনিহারী (১৯৬৩), বনফুলের গল্প (১৯৩৬) ইত্যাদি।
শুধু কথাসাহিত্যে নয়, কাব্য কবিতা নাটক কিংবা প্রবন্ধও লিখেছেন তিনি। তাঁর প্রথম প্রহসন ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ (১৯৩৮) রবীন্দ্রনাথ কেও মুগ্ধ করেছিল। বিদ্যাসাগরের জীবন নিয়ে ১৯৪১ খ্রিঃ লিখেছিলেন ‘বিদ্যাসাগর’ নাটক। ‘শ্রীমধুসূদন’ও তাঁর জীবনী বিষয়ক নাটক। ১৯৪৫ খ্রিঃ রচিত ‘কঞ্চি’ নাটকটি বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল।  তাঁর অন্যান্য নাটকগুলির মধ্যে আছে ‘রূপান্তর’ (১৯৩৮), মধ্যবিত্ত (১৯৪৩), ত্রিনয়ন (১৯৪৬)।

বনফুলের কিছু প্রবন্ধও আছে। ১৯৫৫ খ্রিঃ লেখা ‘শিক্ষার ভিত্তি’ সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রচিত। আর একটি প্রবন্ধ ‘দ্বিজেন্দ্র দর্পণ’ (১৯৬৭) নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সম্পর্কে স্মারক বক্তৃতা।  কমলাকান্তের ভঙ্গীতে লিখেছিলেন ‘ভূয়োদর্শন’ (১৯৪২)।

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়, টার্গেট এসএসসি বাংলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *