বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়  ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে উত্তর চব্বিশ পরগণার কাঁঠাল পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন।

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এন্ট্রান্স এবং ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বি.এ পাশ করেন। তিনিই ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক। ১৮৫৮খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন এবং প্রায় ৩৩ বৎসর চাকরি করার পর ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন।সরকারি চাকরিতে তাঁর যোগ্যতা ও কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে সরকার তাঁকে রায়বাহাদুর এবং সি.আই.ই. উপাধিতে ভূষিত করেন।

বাল্যকাল থেকেই তিনি সাহিত্য সাধনা শুরু করেছিলেন। ১৮ বৎসর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ললিতা’ ও ‘মানস’ প্রকাশিত হয়।বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাকে প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয়। গীতার ব্যাখ্যাদাতা ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান। তার লেখালেখিতে হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ স্থান পেয়েছে। ৫ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে তার হাতেখড়ি হয়। শৈশবেই তার প্রতিভার স্ফূরণ লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার তাদের বাড়িতে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্তছিলেন।

১৮৪৪ সালে মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৪৯ সালে কাঁঠালপাড়ায় ফিরে শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন।ওই বছরই হুগলি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াকালে ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথমস্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন।১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়ে ২ বছরের জন্য বিশ টাকা বৃত্তি পান।ওই বছরই আইনশাস্ত্রে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৫৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রথমবারের বিএ পরীক্ষায় দশজন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেন শুধু বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু।বাবার মতো তিনিও পড়াশোনা শেষে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।কলেজে পড়াকালে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে তার গদ্য ও কবিতা ছাপা হয়। ১৮৫৩ সালে সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিশ টাকা পুরস্কার পান। তিনি ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। তবে তিনি লেখক এবং হিন্দু পুনর্জাগরণের দার্শনিক হিসেবেই বিখ্যাত। তিনি বিখ্যাত বঙ্গদর্শন (১৮৭২-১৮৭৬) পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে একটি নতুন লেখকগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। তার লেখনিতে প্রাচীন ভারতের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠে। তিনি কমলাকান্ত ছদ্মনামেও লেখালেখি করেন।

উপন্যাস 
দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), ইন্দিরা (১৮৭৩), যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রাধারাণী (১৮৮৬), রজনী (১৮৭৭), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮), রাজসিংহ (১৮৮২), আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪), সীতারাম (১৮৮৭) ও Rajmohan’s Wife.

প্রবন্ধ
কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫), লোকরহস্য (১৮৭৪), কৃষ্ণচরিত্র (১৮৮৬), বিজ্ঞানরহস্য (১৮৭৫), বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬), প্রবন্ধ-পুস্তক, সাম্য (১৮৭৯) ও বিবিধ প্রবন্ধ (১ম খণ্ড : ১৮৮৭, ২য় খণ্ড : ১৮৯২)।
অন্যান্য
ললিতা, ধর্ম্মতত্ত্ব অনুশীলন (১৮৮৮), সহজ রচনা শিক্ষা, শ্রীমদ্ভগবদগীতা (১৯০২) ও কবিতাপুস্তক।
সম্পাদনা
দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী, বাঙ্গলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী।
১১ বছর বয়সে বিয়ে করেন নারায়ণপুর গ্রামের ৫ বছর বয়সী মোহিনী দেবীকে।১৮৬০ সালের জুন মাসে হালিশহরের রাজলক্ষী দেবীকে বিয়ে করেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন দীর্ঘ নয়, তারই মধ্যে তাঁর সাহিত্য সাধনা বিস্ময়কর। হুগলি কলেজে ছাত্রজীবনে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনার আদর্শে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ ও ‘সংবাদ সাধুরঞ্জনে’ গদ্য, পদ্য লিখতেন। ৪২ বছরের
সাহিত্যসাধনা তাঁর ছাত্রজীবন, কর্মজীবন, শেষ জীবন পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি শেষ লেখা লেখেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩৪। ইংরেজি ভাষায় দক্ষ বঙ্কিমচন্দ্র খুলনায় ‘Rajmohan’s Wife’ নামে এক ইংরেজি উপন্যাস রচনা করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাহিত্য জীবনের আরম্ভ। বঙ্গদর্শনের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যে যুগান্তর এনেছিল। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রের বিশিষ্ট অবদান হল প্রবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যের বিকাশ ও বিস্তার। বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যযুগের রচনায় দেখা যায় সৌন্দর্য ও লোকশিক্ষার মিলন। শেষ যুগে লোকশিক্ষার প্রাধান্য।প্রতিভার শেষ ধাপে প্রকাশিত পত্রিকা ‘নবজীবন’ ও প্রচার। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার শেষ পর্যায় পূর্ণভাবে প্রকাশ পেল স্বাদেশিকতা ও অনুশীলন ধর্মের ব্যাখ্যা। ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’র নায়ক নেশাখোর কমলাকান্তের মুখে মাতৃপ্রেমের প্রথম প্রকাশ ‘আনন্দমঠের’ ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেল।বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সব উপন্যাসই ইংরেজি, জার্মান, হিন্দি, কানাড়া, তেলুগু প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।তাঁর উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চে অভিনীত ও সিনেমায় রূপায়িত হয়েছে। উপন্যাসগুলির নাটকীয়তা ও রোমান্টিকভাব সফলতার একটা কারণ। ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিস্তৃত আঙিনায় বাঙালির রোমান্টিক মনকে প্রথমে মুক্তি দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভাষা ও উপন্যাসের কাঠামো তৈরির বিষয়ে তিনি পথ দেখিয়েছিলেন। দেশের রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষামূলক উন্নতির সব রকম প্রয়াসে তিনি অবিরাম লেখনী চালনা করেছেন। ‘আনন্দমঠের’ ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয় ভাব প্রবুদ্ধ করেছে, অপূর্ব দেশপ্রীতির উদ্ভব ঘটিয়েছে।বঙ্কিমচন্দ্র কেবলমাত্র সাহিত্যিক বা লেখক নন, উপরন্তু তিনি যুগস্রষ্টা। ঐতিহাসিক, রোমান্টিক, পারিবারিক,এই তিন ধারায় উৎসারিত বঙ্কিমচন্দ্রের আখ্যানগুলির সমসাময়িক ও পরবর্তী সাহিত্য ও জীবনের ওপর অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছে।

সরকারি চাকরি ও সাহিত্যসেবায় আত্মনিয়োগ করে বঙ্কিমচন্দ্র যে কঠোর পরিশ্রম করতেন তাতে তাঁর স্বাস্থ্য অকালে ভেঙে পড়েছিল। ফলে মাত্র ছাপান্ন বৎসর বয়সে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি পরলোক গমন করেন। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ৪০ বৎসর ধরে নিরলস সাধনায় বঙ্গসাহিত্যকে যেভাবে তিনি সমৃদ্ধশালী করেছেন বাঙালি কৃতজ্ঞ চিত্তে তা চিরকাল স্মরণ করবে।

আলোচক – কুতুব আলী, বাংলা ছাত্র, রায়গঞ্জ, দিনাজপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *