বাউল গান

বাউল গান – মনের মানুষের গান

বাউল গান  বলতে একধরনের অধ্যাত্ম সংগীতকে বোঝায়। বাংলা অধ্যাত্ম সংগীতের ধারায় বাউল গানের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ‘বাতুল’ শব্দ থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি। অর্থাৎ যাঁরা ঈশ্বরপ্রেমী,বাতুল বা পাগল, তাঁরাই বাউল। আবার অনেকের মতে,’বায়ু’ শব্দের সঙ্গে ‘ল’ প্রত্যয় যোগ করে ‘বাউল’ কথার উৎপত্তি। এঁরা দেহে বায়ু বা স্নায়বিক সঞ্চার ঘটিয়ে বা শ্বাস-প্রশ্বাস রোধ করে বিশেষ পদ্ধতিতে সাধনভজন করেন বলে ‘বাউল’ নামে খ্যাত।এই শ্রেণির সাধকরা হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত।

বাউল সাধনা

বাউল গান  কবিগান অপেক্ষা অধিক জনপ্রিয়। তরজা,আখড়াই,কবিগান এখন আর শোনা হয় না।এরা এখন লুপ্তপ্রায়। কিন্তু বাউল গান আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বাউলরা ‘মনের মানুষ’ খোঁজেন।তাঁরা বিশ্বাস করেন ‘মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ’। এঁরা জাতপাত মানেন না।তাই আজও এঁরা মানুষের কাছে শ্রদ্ধা পায়। বাউল গান বাউল সম্প্রদায়ের সাধনসঙ্গীত। এটি লোকসঙ্গীতের অন্তর্গত। এ গানের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। অনুমান করা হয় যে, খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক কিংবা তার আগে থেকেই বাংলায় এ গানের প্রচলন ছিল। বাউল গানের প্রবক্তাদের মধ্যে লালন শাহ্, পাঞ্জ শাহ্, সিরাজ শাহ্ প্রধান।নগর সভ্যতা যতই নগর সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে বাঁচুক না কেন বাংলা থেকে বাউল গান কখনো হারিয়ে যাবে না।

বাউল সাধনা বিশ্বের অন্যতম মরমিয়া সাধনা। এই সাধকেরা বৈদিক হিন্দু এবং শরিয়তি ইসলাম থেকে বহুদূরে অবস্থান করেন। মানবতার সন্ধানই তাঁদের মূল লক্ষ্য।মানুষের মধ্য দিয়েই তাঁদের ঈশ্বরের সন্ধান।বাংলার লৌকিক ধর্ম ও লোকজীবন পরিচয়ের অন্যতম শিল্পমাধ্যম এই বাউল গান।বাউল গানে কেউ কেউ শাস্ত্রীয় রাগসঙ্গীতের প্রভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু এ গান মূলত ধর্মীয় লোকসঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উন্মেষ ও বিকাশ লোকসঙ্গীতের অনেক পরে। আধুনিক শিল্পীদের কণ্ঠে কখনও কখনও রাগের ব্যবহার হলেও তা সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়।

আরও পড়ুন

বাউল গানে সাধারণত দুধরনের সুর লক্ষ করা যায় প্রথম কলি অর্থাৎ অস্থায়ীতে এক সুর এবং অন্য সব কলিতে কিছুটা ভিন্ন সুর। সবশেষে দ্রুতগতিতে দ্বিতীয় কলির অংশবিশেষ পুনরায় গীত হয়। এ গানে অস্থায়ী এবং অন্তরাই প্রধান। অস্থায়ীকে কখনও ধুয়া, মুখ বা মহড়া বলা হয়। দ্রুত লয়ের এ গানে প্রতি অন্তরার পর অস্থায়ী গাইতে হয়। কোনো কোনো গানে সঞ্চারী থাকে; আবার কোনো কোনো গানে নাচেরও প্রচলন রয়েছে, যার উৎস গ্রামীণ পাঁচালি গান বলে মনে করা হয়।

তবে আখড়া আশ্রিত বাউল গানে নাচের প্রচলন নেই। কিছু কিছু বাউল গান কীর্তন আশ্রিত। বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে এমনটি হয়েছে। তবে বাউল গানে সুফিভাবনাই প্রবল।বাউল সাধকেরা ধরা-অধরার এক আশ্চর্য দ্বন্দ্বে জীবন কাটিয়ে দেন।হৃদয়ের মধ্যেই নিহিত পরমশক্তি অথচ তাঁর সঙ্গে দুস্তর ব্যবধান।

বাউলরা কেবল ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়,তাঁরা গায়ক সম্প্রদায়ও।তবে তাঁদের ধর্মসাধনার মাধ্যম গান।অক্ষয়কুমার দত্ত বাউলদের ‘উপাসক সম্প্রদায়’ বলে উল্লেখ করেছেন।বাউলরা ভাবের পাগল। তাঁদের প্রেমভাবই মুখ্য।বাউলদের পাগল,ক্ষ্যাপা বা গোঁসাইও বলা হয়।বাউলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকির লালন শাহ।তিনি প্রতিভাবান কবি।তিনি প্রায় দু-আড়াই হাজার গান রচনা করেন।রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে মুগ্ধ ছিলেন।তিনি হিন্দু না মুসলিম সেই বিতর্ক আজও চলছে।আসলে তিনি সর্বসংস্কারমুক্ত এক মরমিয়া সাধক। তাঁর গানে পাই -“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে,লালন কয় জাতের কীরূপ দেখলাম না এই নজরে।”

পরিশেষে বলা যায়,লৌকিক আচার-বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাহীন জাতিসম্প্রদায়ের পরিচয়হীন বাউলেরা তাঁদের গানের মধ্য দিয়ে সাধনার কথাকেই প্রকাশ করেছেন।

কিছু বাউল গান

(০১) আমি কোথায় পাবো তারে/আমার মনের মানুষ যে রে –  গগন হরকরা ।

(০২) কোথায় পাবো তারে/লাগি সেই হৃদয় শশী/সদামন হয় উদাসী —  গগন হরকরা ।

(০৩) কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে – গগন হরকরা।

(০৪) বিচার করি চাইয়া দেখি সকলেই আমি – হাসন রাজা।

(০৫) আমি আমার পরিচয় করায়েছি – হাসন রাজা

(০৬) আমি নমাজ পড়তাম কোন দিকে চাইয়া – হাসন রাজা।

(০৭) কানাই তুমি খেউড় খেলাও কেনে – হাসন রাজা।

(০৮) যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান – লালল ফকির।

(০৯) জগত বেড়ে জেতের কথা/লোকে গৌরব করে যথাতথা – লালল ফকির।

(১০) কেউ মালা কেউ তজবী গলায় – লালল ফকির।

(১১) আছে যার মনের মানুষ মনে সে কি জপে মালা – লালল ফকির।

(১২) একদিন পারের কতা ভাবলি না রে – লালল ফকির।

(১৩) সাই আমার কখন খ্যেলে কোন খেলা – লালল ফকির।

(১৪) গুরু বস্তু চিনলে না/অপারের কান্ডারি গুরু – লালল ফকির।

(১৫) ওগো রাই সাগরে নামলো শ্যামরায় – লালল ফকির।

আলোচক – কুতুব আলী, টার্গেট এসএসসি বাংলা।