সাময়িক পত্রিকা

সংবাদ প্রভাকর – বাংলার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাময়িক পত্রের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা গদ্য তথা সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিপুষ্টি সাধনে এই সাময়িক পত্র নানা ভাবে ভূমিকা পালন করে আসছে। ‘দিগদর্শন’ থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা সাময়িক পত্রের যে দীর্ঘ পথ চলা তাতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে ‘সংবাদ প্রভাকর‘। আমাদের এই আলোচনায় এই পত্রিকাটি সম্পর্কে একটি সুসংবদ্ধ আলোচনা করা হয়েছে।

সূচনা কথা

১৪ জুন, ১৮৩৯ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ বাংলায় প্রকাশিত সর্বপ্রথম দৈনিক পত্রিকারূপে আবির্ভূত হয়

সংবাদ প্রভাকর বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রথম প্রকাশের তারিখ ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারি, শুক্রবার (১৬ মাঘ, ১২৩৭ বঙ্গাব্দ)। প্রকাশক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। পত্রিকাটি প্রকাশে পাথুরিয়া ঘাটার যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের ভূমিকা ও সহযোগিতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ও অপরিহার্য। তাঁর মৃত্যুর কারণে ১৮৩২ সালের ২৫ মে প্রকাশিত ৬৯তম সংখ্যার পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পুনরায় সংবাদ প্রভাকর প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৮৩৬ সালের ১০ আগস্ট থেকে পত্রিকাটি বারত্রয়িক রূপে অর্থাৎ সপ্তাহে তিনদিন প্রকাশিত হতে থাকে। পুনরায় পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার পত্রিকা প্রকাশে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে। ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন সংবাদ প্রভাকর বাংলায় প্রকাশিত সর্বপ্রথম দৈনিক পত্রিকারূপে আবির্ভূত হয়।

১৮৫৩ সাল থেকে পত্রিকাটির মাসিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মাসিক সংবাদ প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্র প্রাচীন বাংলার ‘কবিয়াল’ ও গীতিকারদের জীবনী ও কর্মগাথা সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রামচন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক নিযুক্ত হন। ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে তাঁর পক্ষে এ দায়িত্ব বেশিদিন পালন করা সম্ভব হয়নি এবং তাঁর স্থলে গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দায়িত্ব লাভ করেন। সম্ভবত মণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত ছিলেন সংবাদ প্রভাকরের সর্বশেষ সম্পাদক। পত্রিকাটি বিশ শতকের প্রথম ভাগের বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। 

গুরুত্ব


সংবাদ প্রভাকর উনিশ শতকের একটি প্রথম শ্রেণির পত্রিকা, যাতে ভারতবর্ষসহ বহির্বিশ্বের সংবাদের পাশাপাশি ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়েও রচনা প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটিতে তৎকালীন বহু বিখ্যাত পন্ডিত ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি তাঁদের রচনা প্রকাশ করতেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, জয়গোপাল তর্কালংকার, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রামকমল সেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং দীনবন্ধু মিত্রের লেখক জীবনের প্রথম পর্যায়ের অনেক রচনাই সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা লেখকদল পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন এবং পত্রিকাটির প্রাথমিক রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালে কিছুটা নমনীয় ও উদার হয়েছিল। 

১৮৪০ ও ১৮৫০-এর দশকে পত্রিকাটি নারীশিক্ষা ও বিধবা-বিবাহের প্রতি সমর্থন প্রদান করা ছাড়াও কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জমিদারদের সহায়তার কারণে পত্রিকাটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ততটা জোরালোভাবে সমালোচনা না করে বরং শাসকদের পক্ষেই অবস্থান নেয়। তবে, নীলচাষের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সংবাদ প্রভাকর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সংক্ষেপে বলা যায় যে, পত্রিকাটিতে উনিশ শতকের বাংলা রেনেসাঁর ভাবধারার প্রতিফলন ঘটেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, পত্রিকাটির প্রকাশিত সবগুলি সংখ্যা কোন গ্রন্থাগারেই সংরক্ষিত হয়নি। তবে, কলকাতার বঙ্গীঁয় সাহিত্য পরিষদ ও জাতীয় গ্রন্থাগারে এর কয়েকটি সংখ্যা সংরক্ষিত রয়েছে।

আলোচক – শ্রীযুক্ত প্রতাপচন্দ্র সাহা, শিক্ষক, নদীয়া

One thought on “সংবাদ প্রভাকর – বাংলার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *