বাংলা সাহিত্যশ্রীকৃষ্ণকীর্তন

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” পরিক্রমা

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদের পরেই উল্লেখযোগ্য হল “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য”। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে প্রবেশ করলে প্রথম কাব্য “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”। বাংলা সাহিত্যের ২য় গ্রন্থ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। কোনো একক কবির রচনা হিসেবে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য রচনা করেছেন বড়ু চন্ডীদাস পক্ষান্তরে চর্যাপদের পদকর্তা ২৪ জন

কবির পরিচয়

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” এর কাব্যের কবি হলেন বড়ু চন্ডীদাস এটি তার ছদ্মনাম বা উপাধি তার প্রকৃত নাম অনন্ত বড়ুয়া / অনন্ত বড়ু / অনন্ত বড়াই তিনি যাত্রাপালা / নাট্যপালার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন সেকারণে নাটকীয় ভঙ্গিতে তিনি এই কাব্য রচনা করেন।

বড়ুচন্ডীদাসঃ

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” এর রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। যদিও তাঁর আত্মপরিচয় বা জীবনকথা জাতীয় কিছু পাওয়া যায় না বলে তাঁর প্রকৃত পরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কাব্যে তাঁর তিনটি ভণিতা পাওয়া যায় –
‘বড়ুচণ্ডীদাস ’, ‘ চণ্ডীদাস’ ও ‘ আনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস’ । এর মধ্যে ‘ বড়ু চণ্ডীদাস ’ ভণিতা মিলেছে ২৯৮টি স্থানে ও ‘ চণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ১০৭ বার। ৭টি পদে ব্যবহৃত ‘ অনন্ত ’ শব্দটি প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে করা হয়। কেউ কেউ মনে করেন , চণ্ডীদাস তাঁর নাম এবং বড়ু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কৌলিক উপাধি বাঁড়ুজ্যে বা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপভ্রংশ। কবি চৈতন্যপূর্ববর্তীকালের মানুষ। সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি জীবিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাঁকুড়া ও বীরভূমের মধ্যে যত বিবাদই বিদ্যমান থাকুক না কেন , ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন , ‘ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ’ রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। বড়ুচণ্ডীদাস বাসলী দেবীর উপাসক ছিলেন। এই বাসলী দেবী প্রকৃতপক্ষে শক্তিদেবী মনসার অপর নাম।

রচনাকালঃ চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ দিকে পনের শতাব্দীর শুরুতে রচিত হয়

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” – এর বিষয়বস্তু

১. এ কাব্যে মোট ১৩টি খন্ড রয়েছে
২. এ কাব্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রাধা – কৃষ্ণ এর প্রেমলীলা বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রেক্ষাপটঃ
এ কাব্যটি রচনার ৫০০ বছর পর আবিষ্কার করা হয়। বর্তমানে কাব্যটির বয়স ৬০০ বছর। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় যার উপাধি বিদ্বদ্ববল্লভ। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামে এক
গৃহস্থলীর গোয়াল ঘরের টিনের চালের নীচ থেকে আবিস্কার করেন। ১৯১৬ সালে কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয় শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ যা পরে নাম পরিবর্তন করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য রাখা হয়।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” এর প্রধান চরিত্র

১. রাধা ২. কৃষ্ণ ৩ . বড়াই
১ . রাধা: এ কাব্যে রাধা কেন্দ্রীয় নারী তথা নায়িকা চরিত্রে ঘোষ পরিবারে জন্ম। অপূর্ব সুন্দরী রাধার বিয়ে হয় বীরপুরুষ আয়ান ঘোষ / আইহন ঘোষ এর সাথে। আয়ান ঘোষের গৃহে রাধার দেখাশুনার দায়িত্বভার পরে তার পিসিমা বড়াই এর উপর। পৌরাণিক কাহিনী মতে রাধা মানবাত্নার প্রতীক। এ কাব্যে রাধা রক্তমাংসে গড়া এক নারী যার মনে প্রেম আছে আবার দৈহিক কামনা বাসনা চরিতার্থ করার আকাঙ্ক্ষাও আছে।
২ . কৃষ্ণঃ এ কাব্যের কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র। তার প্রধান গুণ বাঁশীবাদক / বংশীবাদক। তার প্রধান পরিচয় রাধার প্রেমিক রূপে। রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের প্রতিবেশী মামী ছিলেন। পৌরাণিক কাহিনীমতে কৃষ্ণ হচ্ছে ভগবান /
স্রষ্টা / পরমাত্না। কিন্তু এ কাব্যে রক্তমাংসে গড়া এক যুবক।
৩ . বড়াইঃ বড়াই এ কাব্যের ৩য় চরিত্র। রাধা কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্ক সৃষ্টিতে বড়াই এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এজন্য বড়াইকে রাধা – কৃষ্ণের প্রেমের দূতী বলা হয়।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” – একনজরে

১. বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের আদি নিদর্শন হল “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য”
২. বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের এক গৃহস্থের গোয়ালঘর থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য উদ্ধার করেন।
৩. গ্রন্থটি ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে বসন্তরঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
৪. ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র রচয়িতা হলেন -বড়ু চণ্ডীদাস। এখানে মনে রাখতে হবে,বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ এবং দ্বিতীয় নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’।’চর্যাপদে’র রচয়িতা হলেন ২৪ জন কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত’ন কাব্যের রচয়িতা হলেন ১ জন (বড়ু চণ্ডীদাস)। তাই বলা যায়,বাংলা সাহিত্যের প্রথম একক কবির রচিত গ্রন্থ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’।
৫.‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র আলোচ্য বিষয় হল রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা।

৬. এখানে রূপকের মাধ্যমে ‘রাধা’ বলতে সৃষ্টি/ভক্ত/জীবাত্মাকে এবং ‘কৃষ্ণ’ বলতে স্রষ্টা/ভগবান/পরমাত্মাকে বুঝানো হয়েছে। তার মানে রাধা-কৃষ্ণের প্রমের মাধ্যমে বৈষ্ণবতত্ত্বের এক গূঢ় রহস্য কথা ব্যক্ত হয়েছে।
যেখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের মাধ্যমে জীবাত্মা- পরমাত্মার প্রেমকে বুঝানো হয়েছে।
৭.আর এই প্রেমের দূতিয়ালি বা ঘটকালি করেছেন বড়াই।
৮. ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের প্রধান চরিত্র হল ৩টি (রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই)।
৯. সর্বজন স্বীকৃত ও খাঁটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম গ্রন্থ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’।
১০.মধ্যযুগের আদি কবি বড়ু চণ্ডীদাস।
১১.‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কাব্যের মূল নাম ছিল ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’। ১৯১৬ সালে প্রকাশের সময় বসন্তরঞ্জন রায় এর নাম পরিবর্তন করে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রাখেন।
১২.‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে ১৩ টি খণ্ড ও ৪১৮ টি পদ আছে।

আলোচক – কুতুব আলি, অ্যাডমিন, টার্গেট এসএসসি বাংলা