ধ্বনিতত্ত্ববাংলা প্রশ্নোত্তর

ভাষা ও উপভাষা – কিছু প্রশ্নোত্তর

সাধারণ আলোচনা – ভাষা ও উপভাষা – কিছু প্রশ্নোত্তর

  • ভাষা‬ ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অনুসরণে বলা যায়, মনের ভাব-প্রকাশের জন্যে বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন, কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে|
  • উপভাষা‬ কোনো ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট দলে বা অঞ্চল বিশেষে প্রচলিত ভাষাছাঁদকে উপভাষা বলে|
  • ‪‎বিভাষা‬ এক একটি উপভাষার অভ্যন্তরেও নানা আঞ্চলিক পার্থক্য গড়ে উঠতে পারেে| উপভাষার মধ্যে গড়ে ওঠা পৃথক আঞ্চলিক রূপকে বিভাষা বলে|
  • ‪‎নিভাষা‬ অনেকসময় কোন ব্যক্তি বিশেষের (অথবা পরিবার বিশেষের) বাগব্যবহারের ধ্বনি, শব্দ অথবা শব্দ প্রয়োগ বিশেষে অল্পস্বল্প স্বাতন্ত্র্য দেখা যায়,এমন ব্যক্তিনিষ্ঠ উপভাষাকে নি-ভাষা বলে|
  • অপভাষা‬ এক ভাষাগোষ্ঠী ব্যক্তি যদি ভাল করে না শিখে অন্যভাষা ব্যবহার করে তবে তার উচ্চারণে বিকৃতি ঘটা খুবই স্বাভাবিক|এইরকম বিকৃত ভাষার ব্যবহারকে বলা হয় অপভাষা| যেমন- স্টেশন>ইস্টিশন|
  • অপার্থ‬ ভাষা বা সঙ্কেত ভাষা সমাজের ইতরশ্রেণি ও অপরাধীদের মধ্যে গোপন সাঙ্কেতিক ইঙ্গিতপূর্ণ যে ভাষা প্রচলিত থাকে তাকে অপার্থ ভাষা বা সঙ্কেত ভাষা বলে|
  • মিশ্রভাষা‬ দুটি ভিন্ন গোষ্ঠী প্রয়োজনের তাগিদে পাশাপাশি বাস করার ফলে যদি উভয়ে উভয়ের ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং কাজ চালানোর মত একটি সরলভাষা তৈরি করে নেয় , তাকে বলে মিশ্রভাষা|
  • সমাজ ভাষা‬ সামাজিক স্তরভেদে একই ভাষাভাষী লোকেদের কথায় অল্পবিস্তর পার্থক্য হতে পারে|যেমন,একজন ব্রাহ্মণ পন্ডিত, একজন অধ্যাপক,একজন উকিল, একজন রাজনৈতিক নেতা,একজন শ্রমজীবী এবং একজন দাগী অপরাধী গুন্ডার ভাষার উচ্চারণে ও শব্দব্যবহারের বেশ পার্থক্য চোখে পড়ে|একই ভাষার মধ্যে সামাজিক স্তরভেদে এই যে পার্থক্য একে সমাজ ভাষা বলে|

প্রশ্নোত্তর


১) ভাষা কাকে বলে ?
ভাষার সংজ্ঞা হিসেবে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অনুসরণে বলা যায় ভাষা হল মনের ভাব প্রকাশের সেই মাধ্যম যা বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত হয়, যা ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্দ ও বৃহৎ জনসমাজে প্রচলিত এবং স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত।

২) উপভাষা কাকে বলে ?
উপভাষা হল কোন একটি ভাষার আঞ্চলিক রূপ যার সাথে আদর্শ ভাষার রূপগত ও ধ্বনিগত পার্থক্য থাকে।

৩) উপভাষা সম্পর্কে ড. সুকুমার সেনের মত কী ?
ড. সুকুমার সেন বলেছেন, উপভাষা হল কোন ভাষার অন্তর্গত ছোট ছোট দল বা অঞ্চল বিশেষে প্রচলিত রূপান্তরকে বোঝায়।

৪) ভাষা ও উপভাষার সম্পর্ক কী ?
ক) ভাষা একটি বৃহৎ অঞ্চলে প্রচলিত, উপভাষা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অঞ্চলে।
খ) যেকোন ভাষার সর্বজন গ্রাহ্য আদর্শ রূপ থাকে উপভাষার মত অঞ্চল্ভেদে তার ব্যবহার নয়।
গ) ভাষায় রচিত হয় আদর্শ সাহিত্য, উপভাষায় যা লেখা হয় তা লোকসাহিত্য।
ঘ) ভাষা যদি হয় সর্বজন গ্রাহ্য তবে উপভাষা নির্দিষ্ট অঞ্চল গ্রাহ্য।

৫) বাংলা ভাষার কথ্য উপভাষা কয়টি ও কি কি ?
বাংলা ভাষার কথ্য উপভাষা পাঁচটি। সেগুলি হল – রাঢ়ী, বঙ্গালি, বরেন্দ্রী, ঝাড়খণ্ডী ও কামরূপী।

৬) রাঢ়ী উপভাষার দুটি ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লিখুন।
ক) রাঢ়ী উপভাষায় স্বরসঙ্গতি ঘটে। যেমন – দেশি > দিশি
খ) এই উপভাষায় শব্দের শেষে মহাপ্রাণ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ধ্বনি হিসেবে উচ্চারিত হয়। যেমন – মাছ > মাচ্‌

৭) রাঢ়ী উপভাষার দুটি রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লিখুন।
ক) রাঢ়ী উপভাষায় অধিকরণ কারকে ‘এ’ ও ‘তে’ বিভক্তির প্রয়োগ ঘটে। যেমন – বাবা বাড়িতে নেই, তিনি স্বর্গে গেছেন।
খ) কতৃকারক ছাড়া অন্য কারকের বহুবচনে ‘দের’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন – আমাদের বই দাও।

৮) বঙ্গালি উপভাষার দুটি ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লিখুন।
ক) বঙ্গালি উপভাষায় ‘এ’ ধ্বনি ‘অ্যা’ রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন – কেন > ক্যান, শেষ > শ্যাষ
খ) এই উপভাষায় নাস্যিকীভবন ঘটে না। চন্দ্র > চান্দ

৯) বঙ্গালি উপভাষার দুটি রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লিখুন।
ক) বঙ্গালি উপভাষায় কতৃকারকে ‘এ’ বিভক্তির ব্যবহার হয়। যেমন – রামে যায়, মায়ে ডাকে
খ) এই উপভাষায় অধিকরণ কারকে ‘ত’ বিভক্তির প্রয়োগ ঘটে। যেমন – হাড়িত বাত নাই, বাড়ীত থাকুম।

১০) বরেন্দ্রী উপভাষার দুটি ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লিখুন।
ক) বরেন্দ্রী উপভাষায় শব্দের শুরুতে যেখানে ‘র’ ধ্বনি থাকে না সেখানে তার আগম হয়। যেমন – রামের রাজ্য > আমের আজ্য, রাস্তা > আস্তা
খ) এই উপভাষায় শব্দস্থিত ‘এ’ ধ্বনি ‘অ্যা’ রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন – দেন > দ্যান

তথ্যসূত্র – সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা – রামেশ্বর শ, ভাষার ইতিবৃত্ত – ডঃ সুকুমার সেন।

আলোচক – কেশব মল্লিক, শিক্ষক এবং  নীলরতন চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *