চৈতন্যজীবনীবাংলা সাহিত্য

বৈষ্ণব সম্প্রদায় সম্বন্ধে কিছু কথা

বৈষ্ণব সম্প্রদায় মহাপ্রভূ শ্রীচৈতন্যদেব দ্বারা প্রবর্তিত ও বহুল সমৃদ্ধ। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা হলেন মানবতাবাদী।

প্রচলিত ধারণা অনুসারে এই মতবাদ বাঁ ধর্মের আদিগুরু হলেন ব্রহ্মা। বিষ্ণুর নানা রূপকে এই মতবাদে একটিই ঈশ্বর বলে মনে করা হয়। এই প্রচ্ছদে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পণ্ডিত ও ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের রচনার পরিচয় পাওয়া যাবে।

চৈতন্য পরিকর  চৈতন্যসহ পাঁচ পরিকর বা পার্ষদকে স্বরূপ দামোদর ‘পঞ্চতত্ত্ব’ রূপে আখ্যাত করেছেন। কবিকর্ণপুর সংকলিত ‘গৌরগনোদ্দেশ দীপিকায়’ এই তত্ত্ব গৃহীত হয়। নবদ্বীপ লীলা পরিকরদের প্রধান পাঁচ মহাপুরুষকে পাঁচটি তত্ত্বের আধার হিসাবে ধরে নিয়ে পঞ্চতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা। চৈতন্যলীলার মুখ্য পরিকর হলেন যথাক্রমে নিত্যানন্দ,অদ্বৈত,গদাধর,শ্রীবাস এবং চৈতন্যকে নিয়ে পাঁচ।

নিত্যানন্দ  গৌড়ভূমিতে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারে যার দান,দায়িত্ব ও কৃতিত্ব সর্বাধিক গৌরবপূর্ণ তিনি ‘অবধূত’ নিত্যানন্দ প্রভু। আপামর জনসাধারণ ও আদ্বিজ-চণ্ডালের মধ্যে কৃষ্ণনাম প্রচার ও চৈতন্যের গুণকীর্তন নিত্যানন্দ ভিন্ন অন্য কারও দ্বারা সম্ভব হত না।
সংসার-আশ্রমে নিত্যানন্দের নাম ছিল কুবের এবং সন্ন্যাস-আশ্রমে নাম হয় নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দ বীরভূমের একচাকা গ্রামে ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে মাঘ মাসে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম হাড়াই পণ্ডিত বা হাড়ো ওঝা,মাতা পদ্মাবতী। নিত্যানন্দ গৃহত্যাগ করে বিভিন্ন তীর্থ পর্যটনে বের হন। তার ‘অবধূত’ উপাধি দেখে মনে হয় তিনি পূর্বে শৈবমতে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি গৌরাঙ্গের আকর্ষণে নবদ্বীপে আসেন। গৌরাঙ্গের দাদা বিশ্বরূপের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় সকলে মনে করেন তিনি বিশ্বরূপ। শচীদেবী অনাত্মীয় নিত্যানন্দকে সন্তানের স্নেহে আশ্রয় দিলেন। নিত্যানন্দ বৈষ্ণব সমাজে বলরামের অবতার বলে স্বীকৃত। নিত্যানন্দ চৈতন্যের বিগ্রহ পূজার প্রথম প্রবর্তক। নিত্যানন্দ চৈতন্যের তিরোধানের পর গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করেন। কালনার গৌড়দাস পণ্ডিতের ভ্রাতা সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবীকে নিত্যানন্দ বিবাহ করেন,তখন তার বয়স ছাপ্পান্ন বছর। এই জাহ্নবী দেবী এবং পুত্র বীরভদ্র(বীরচন্দ্র) পরবর্তী কালে বৈষ্ণব সমাজে নিত্যানন্দ গোষ্ঠীর নেতা হয়েছিলেন। ‘চৈতন্যভাগবত’ এর রচয়িতা বৃন্দাবন দাস নিত্যানন্দের শিষ্য ছিল ও নিত্যানন্দের নির্দেশেই ‘চৈতন্যভাগবত’ রচনা করেন।

অদ্বৈত আচার্য  ভক্তিধর্ম প্রচারে ভক্তরূপ মহাপ্রভুর দ্বিতীয় অন্তরঙ্গ এবং লীলাসহায় হলেন অদ্বৈত আচার্য। এঁকে ভক্তাবতার বলা হয়েছে। শ্রীচৈতন্যসহ সমস্ত ভক্তের অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ইনিই প্রত্যক্ষ কারন।
১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে অদ্বৈত্য শ্রীহট্ট জেলার লাইড় পরগণার নবগ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। বাল্যকালে অদ্বৈতের নাম ছিল কমলাক্ষ ( কমলাকর)। তাঁর পিতা কুবের তর্কপঞ্চানন বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। বেদ পাঠের জন্য তিনি বেদ ‘পঞ্চানন’ উপাধি লাভ করেন। বার বছর বয়সে তিনি পিতার সঙ্গে নদীয়া জেলার শান্তিপুরে চলে আসেন। নৃসিংহ ভাদুরীর সীতা ও শ্রীনাম্নী দুই কন্যাকর বিবাহ করেন।
কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য তাঁকে ‘অদ্বৈত’ এবং ভক্তি প্রচারের জন্য ‘আচার্য’ বলা হয়। তাকর মতান্তরে সদাশিবও বলা হয়। শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পরেও কিছুকাল জীবিত ছিলেন। তিনি চৈতন্যদেবকে অবতার বলে ঘোষনা করেন।

গদাধর পণ্ডিত  পঞ্চতত্ত্বের ব্যাখায় গদাধর পণ্ডিতকে বলা হয়েছে ভক্তশক্তি। তিনি নবদ্বীপে অধিবাসী এবং শ্রীচৈতন্যের একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। নবদ্বীপে মহাপ্রভুর যখন কৃষ্ণভাব হয় তখন এবং কীর্তন ভাবাবেশের সময় গদাধর মহাপ্রভুর বামপাশে থাকতেন। গদাধর ছিলেন লক্ষ্মী বা রাধার ভাব। সেইভাবের তার চৈতন্য প্রীতি। শ্রীচৈতন্যকে অদ্বৈত আচার্য যখন ভগবানের অবতার বলে ঘোষনা করেন তখন গদাধরই ছিলেন প্রত্যক্ষ সমর্থক। শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণের পর গদাধরই সংসার ধর্ম ত্যাগ করে নীলাচলে চৈতন্যের নিত্যসঙ্গী রূপে বসবাস করতেন।

শ্রীবাস  পঞ্চতত্ত্বে শ্রীবাসকে ভক্তরূপে স্থান দেওয়া হয়েছে। নবদ্বীপ লীলা পরিকরদের মধ্যে শ্রীবাসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও ভক্তি ছিল অতুলনীয়। সেইজন্য তাঁকে ভক্তের তত্ত্বরূপে দেখা হয়েছে। শ্রীবাসের গৃহেই চৈতন্যের ভক্ত সমাগম হত এবং নৃত্যসংকীর্তনে মুখরিত থাকত। শ্রীবাস এবং তাঁর পত্নি মালিনী দেবী প্রখুলীলার যাবতীয় ভার অকাতরে বহন করতেন।

চৈতন্যের অন্যান্য ভক্তগণ  যবন হরিদাস, ছোটো হরিদাস,স্বরূপ দামোদর( পুরুষোত্তম আচার্য), রায় রামানন্দ ( উৎকলের শ্রেষ্ঠ ভক্ত), বাসুদেব সার্বভৌম( উৎকলের ভক্ত), প্রমুখ ভক্তগণ চৈতন্যের অন্যতম ভক্ত ছিলেন।

বৈষ্ণবদের তিনটি গোষ্ঠী 
শান্তিপুরের গোষ্ঠী  অদ্বৈত আচার্য ও তাঁর পত্নি সীতাদেবী এই বৈষ্ণব সমাজ পরিচালনা করতেন।
খড়দহের গোষ্ঠী  নিত্যানন্দ, তাঁর পুত্র বীরচন্দ্র(বীরভদ্র) ও তাঁর পত্নি জাহ্নবীদেবী এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
শ্রীখণ্ডের গোষ্ঠী(কাটোয়া)  এই বৈষ্ণব সমাজের নেতৃত্বে ছিলেন নরহরি সরকার ও মুকুন্দদাস। এই গোষ্ঠী ই বৈষ্ণব সহজিয়া নামক ‘রাগানুগা’ পন্থী সহজ সাধন-ভজনের উদভাবক।

বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী
বৃন্দাবনের ছয়জন চৈতন্যভক্ত বর্হিবঙ্গে মূলত বৃন্দাবনে সংস্কৃতে ও বাংলায় নানা গ্রন্থ রচনা করে চৈতন্যদেবের আবেগের ধর্মকে সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তির উপর দাঁড় করান। এরাই গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং বাংলার বাইরে প্রচার করেন। এরা ষড় গোস্বামী নামে পরিচিত। ষড় গোস্বামীগণ হলেন সনাতন গোস্বামী,রূপ গোস্বামী,জীব গোস্বামী,রঘুনাথ ভট্ট,গোপাল ভট্ট এবং রঘুনাথ দাস। সনাতন, রূপ ও জীব গোস্বামী —- এই গোস্বামীত্রয়ের রচিত সংস্কৃত গ্রন্থাদিই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্ব,আদর্শ ও দর্শনের মননশীল ভিত্তি প্রস্তুত করেছে। এই তিন গোস্বামীর সহায়তা না পেলে ‘চৈতন্য-কাল্ট’(Cult) কখনো বিশিষ্ট ধর্ম ও দর্শনের মর্যাদা লাভ করতে পারত না।

সনাতন গোস্বামী  সনাতন ও রূপ গোস্বামী দুই ভাই—সনাতন জ্যেষ্ঠ,রূপ মধ্যম এবং অনুপম বা বল্লভ কনিষ্ঠ। জীব গোস্বামী অনুপমের পুত্র। এরা কর্ণাটদেশীয় ব্রাহ্মণ। সনাতন-রূপ হুশেন শাহের নিকট চাকরী করতেন। সনাতনের উপাধি ছিল ‘সাকর মল্লিক’(অর্থ–প্রধান মন্ত্রী)। চৈতন্যদেব সনাতন ও রূপ এই নামকরণ করেন। সনাতন গোস্বামীর রচিত গ্রন্থগুলি হল —-
১. ‘বৃহদ্ ভাগবতামৃত’— এই গ্রন্থটি পৌরাণিক ধরনের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম-সংক্রান্ত কাব্য। স্বয়ং সনাতন এতে ‘দিগ্ দর্শনী’ নামক টীকা সংযোজন করে নিজেই এর দূরূহ অংশ ব্যাখ্যা করেছেন। রূপ গোস্বামী ‘সংক্ষেপ ভাগবতামৃত’ এ এই কাব্যের তত্ত্বাংশকে আরও সংক্ষেপ ও সংহত আকারে পরিবেশন করেছেন।
২. ‘হরিভক্তিবিলাস’
৩. ‘লীলাস্তব’ বা ‘দশম চরিত’(পাওয়া যায়নি)
৪. ‘বৈষ্ণবতোষণী’ (জীব এই গ্রন্থকে সংক্ষিপ্ত করে ‘লঘুতোষণী’ রচনা করেন।):– এই গ্রন্থটি ‘দশমটিপ্পনী’ নামেও পরিচিত। এটি শ্রীমদ্ ভাগবতের দশম স্কন্ধের টীকা। জীব গোস্বামীর মতে সনাতস ১৫৫৪ খ্রিঃ এর টীকা সমাপ্ত করেন। এই টীকায় সনাতন মাধবেন্দ্রপুরীকে কৃষ্ণভক্তির অঙ্কুর রূপে গণ্য করেছেন। এই গ্রন্থের ‘নমষ্ক্রিয়া’ তে সনাতন চৈতন্যদেবকে দেবতা বলে গ্রহণ করেছেন।

রূপ গোস্বামী  রূপ গোস্বামীর উপাধি ‘দবির খাস’ ( অর্থ –একান্ত সচিব, রূপ গোস্বামী হুশেন শাহের একান্ত সচিব ছিলেন)
রূপ গোস্বামীর গ্রন্থ গুলি হল —
কাব্য :– ‘হংসদূত’ ( শিখরিনী ছন্দে ১৪২ টি স্তবকে রচিত এই কাব্যটি একটি দূতকাব্য) ; ‘উদ্ধবসন্দেশ’ ( এটিও দূতকাব্য, ভাগবতের দশম স্কন্ধ অবলম্বনে রচিত। কাব্যটি মন্দাক্রান্তা ছন্দে ১৩১ স্তবকে রচিত) ; ‘স্তবমালা’ ( এটি ৬৪ টি স্তবের সমাহার,এতে চৈতন্য ও রাধা কৃষ্ণের বর্ণনা স্থান পেয়েছে।)
নাটক :– ‘বিদগ্ধমাধব’ ( সাত অঙ্কে সমাপ্ত এই নাটকে রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা বর্ণিত হয়েছে।) ; ‘ললিতমাধব’( এতে বৃন্দাবনলীলা, মথুরালীলা ও দ্বারকালীলা স্থান পেয়েছে) ; ‘দানকেলিকৌমুদী’(এটি একটি ভাণিকা)
রসতত্ত্ব ও অলংকার শাস্ত্র :– ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ ( এই গ্রন্থে বর্ণিত ভক্তি ও শৃঙ্গার রসের এরূপ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিপুণ বিশ্লেষণ এবং মর্ত্যচেতনার অন্তরালবর্তী একটা অশরীরী রহস্যময় অস্তিত্বের এরূপ রসময় ব্যঞ্জনা সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যে দুর্লভ। ভক্তিকে রসে পরিণত করা এবং রসতত্ত্বে কৃষ্ণভক্তির সহজ স্বীকৃতি দানের চেষ্টাই রূপ গোস্বামীর এই বৃহৎ গ্রন্থ রচনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।)
‘উজ্জ্বলনীলমণি’ ( এই গ্রন্থে কৃষ্ণের শৃঙ্গার রসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এই গ্রন্থে রয়েছে। এখানে রূপ গোস্বামী মধুর রতির সাতটি পর্যায় কল্পনা করেছেন — প্রেম,স্নেহ,মান,প্রণয়,রাগ,অনুরাগ এবং ভাব ও মহাভাব)
এই দুটি গ্রন্থ ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর বৈষ্ণবধর্ম,সাহিত্য ও দর্শনকে পরিপূর্ণতা দান করেছে।
কাব্য সংকলন :– ‘পদ্যাবলী’ ( এটি একটি কবিতা সংকলন গ্রন্থ। রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক ভক্তিবাদী বৈষ্ণবের ভক্তিসংবলিত নতুন ও প্রাচীন কবিদের নানা ধরনের কবিতা এতে স্থান পেয়েছে। এতে ১২৫ জন কবির ৩৮৬ টি শ্লোক আছে।)
নাট্যতত্ত্ব :— ‘নাটকচন্দ্রিকা’
ধর্মতত্ত্ব :– ‘সংক্ষিপ্ত ভাগবতামৃত’

জীব গোস্বামী ইনি সনাতন-রূপ গোস্বামীর ভ্রাতা অনুপম(বল্লভ) এর পুত্র। তাঁর রচিত গ্রন্থ গুলি হল —
বৈষ্ণবদর্শন :– ‘ভাগবতসন্দর্ভ’ বা ‘ষট্ সন্দর্ভ’ ( তত্ত্ব সন্দর্ভ,ভাগবৎ সন্দর্ভ,পরমাত্ম সন্দর্ভ,শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ,ভক্তি সন্দর্ভ এবং প্রীতি সন্দর্ভ) ; ‘সর্বসংবাদিনী’।
কাব্য :– ‘গোপারচম্পু’ (গদ্যপদ্য ময়বৃহৎ কাব্য) ; ‘সঙ্কল্পকল্পদ্রুম’(কৃষ্ণের কল্পতরু স্বরূপ ও তাঁর নিত্যলীলা বর্ণিত) ; ‘মাধবমহোৎসব’(নয়টি সর্গে সমাপ্ত এই কাব্যে বৃন্দাবনে রাধা কৃষ্ণের অভিষেক বর্ণিত হয়েছে।) ; ‘গোপালবিরুদাবলী’
ব্যাকরণ ও রসশাস্ত্র :– ‘সূত্রমালিকা’ ; ‘হরিনামামৃত ব্যাকরণ’ ; ‘রসামৃতশেষ’ ; ‘দুর্গমসঙ্গ-মণি’ ; ‘লোচনরোচনী’।
বৈষ্ণবস্মৃতি ও ধর্মতত্ত্ব :– ‘গোপালতাপনী’ ; ‘ব্রহ্মসংহিতা’ ; ‘ক্রমসন্দর্ভ’ ; ‘লঘুতোষণী’ ; ‘কৃষ্ণার্চাদীপিকা’।

রঘুনাথ ভট্ট  রঘুনাথ ভট্ট ছিলেন নির্লোভ,নিরহঙ্কার এবং সংযমী জীবনের আদর্শ স্বরূপ। গ্রন্থ রচনা না করলেও তিনি ছিলেন আদর্শ ভক্ত। চৈতন্যদেব এই ভক্তকে স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন চৈতন্যের প্রথম প্রত্যক্ষ শিষ্য তপন মিশ্রের পুত্র।

রঘুনাথ দাস  ষড়গোস্বামীদের মধ্যে একমাত্র ইনিই ব্রাহ্মণেতর গোস্বামী। তিনি হুগলী জেলার সপ্তগ্রামের জমিদার।
‘দণ্ডমহোৎসব’— রঘুনাথ বাইরে বিষয়ীর মতো আচরণ করতেন কিন্তু অন্তরে বৈরাগ্যের ভাবে শুদ্ধ চিত্ত হয়ে থাকতেন —- তাই তিনি নিত্যানন্দের ভাষায় ‘চোরা’। নিত্যানন্দ বললেন, তোমাকে দণ্ড দেবো। তুমি এই সমস্ত বিভিন্ন জাতির ভক্তকে চিঁড়াদধির ভোজন করাও। তাই ই হল, বহু অর্থ ব্যয় করে রঘুনাথ গঙ্গার তীরে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর ভক্তদের চিঁড়াদধির ‘ভাণ্ডারা’ লাগিয়ে দিলেন, নিত্যানন্দের নিকট তিনি আনন্দে এই দণ্ড গ্রহণ করলেন। এই ঘটনায় বৈষ্ণব সমাজে ‘দণ্ডমহোৎসব’ নামে পরিচিত।
গ্রন্থাবলী— রঘুনাথ দাসের নামে প্রায় ২৯ টি স্তব-স্তোত্র ও কবিতা পাওয়া যায়। তার মধ্যে ‘ ‘বিলাপ কুসুমাঞ্জলী’, ‘প্রেমপরাবিধ স্তোত্র’ ইত্যাদি অনেকগুলি স্তবস্তুতি ‘স্তবমালা’য় সংকলিত আছে।
ক্ষুদ্রকাব্য — ‘মুক্তাচরিত’(চম্পুকাব্য) ; ‘দানকেলিচিন্তামণি’( রূপ গোস্বামীর ‘দানকেলিকৌমুদী’ র আদর্শে রচিত)

গোপালভট্ট  রূপ-সনাতনের তিরোধানের পর গোপাল ভট্ট বৃন্দাবনের বৈষ্ণবদের গুরু বলে গৃহীত হয়েছিলেন। পরবর্তী কালে বৈষ্ণবনেতা সুপ্রসিদ্ধ শ্রীনিবাস আচার্য গোপাল ভট্টের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর নিকট বৈষ্ণবতত্ত্ব শিক্ষা করেন।
তাঁর নামে প্রচলিত গ্রন্থ গুলি হল
‘হরিভক্তিবিলাস’— এটি একটি বৈষ্ণব স্মৃতি গ্রন্থ। এতে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের আচার-আচরণ,সামাজিকতা,কৃত্য প্রভৃতি পুরাণ-তন্ত্র থেকে উল্লেখ সহ ব্যাখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি লীলাশুকের ‘কৃষ্ণকর্ণামৃত’ এর টীকা রচনা করেন।
‘কালকৌমুদী’ ; ‘কৃষ্ণবল্লভী’ এবং ‘রসিকরঞ্জনী’ নামক তিনটি আচার-আচরণ মূলক পুস্তিকা রচনা করেন।

যদুনন্দনের ‘কর্ণামৃত’ গ্রন্থে বৈষ্ণব সমাজের আট জন কবিরাজ ও ছয় জন চক্রবর্তীর বিবরণ আছে।
আট জন কবিরাজ  ১. রামচন্দ্র কবিরাজ(জ্যেষ্ঠ), ২. শ্রীকবিরাজ গোবিন্দ, ৩. শ্রীকর্ণপুর কবিরাজ, ৪. শ্রীনৃসিংহ কবিরাজ, ৫. ভগবান কবিরাজ, ৬. বল্লবীদাস কবিরাজ, ৭. শ্রীগোপীরমণ কবিরাজ, ৮. কবিরাজ শ্রীগোকুলানন্দ।
ছয় জন চক্রবর্তী  ১. গোবিন্দ চক্রবর্তী, ২. শ্যামদাস চক্রবর্তী, ৩. রামচন্দ্র চক্রবর্তী, ৪. ব্যাস চক্রবর্তী, ৫. রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী, ৬. গোকুলানন্দ “চক্রবর্তী।

লিখেছেন – শুভাশিষ ঘোষ, বাংলা ছাত্র, বেথুয়াডহরী, নদীয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *