বাক্যতত্ত্ব

শব্দ ও শ্রেণিবিন্যাস

যেকোনো ভাষার ক্ষেত্রে শব্দ ও তার শ্রেণিবিন্যাস অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। ভাষা যা আমাদের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম তা বাক্যের মাধ্যমে সম্পূর্ণতা পায়। আর বাক্যের গঠনে শব্দের ভূমিকা অস্বীকার করার নয়। যদিও আমরা বাক্য গঠনের ভূমিকায় শব্দকে নয়, পদকেই গুরুত্ব দেব। প্রশ্ন হল শব্দই বা কী আর পদই বা কী ? এই দুয়ের সম্পর্ক বা তফাৎটাই বা কোথায় ? আসুন দেখা যাক।

শব্দ ও পদ

আমাদের প্রথমেই মনে রাখতে হবে, বাক্যে বসার যোগ্যতা আছে কেবল পদের, শব্দের নয়। প্রতিটি বাক্যের অর্থ সমৃদ্ধ প্রতিটি অংশই হল পদ। এই পদ আমরা পাই কোনো শব্দের সঙ্গে বিভক্তিকে যুক্ত করে। অর্থাৎ বিভক্তিযুক্ত শব্দই হল পদ। উল্টোদিকে বিভক্তিহীন পদ হল শব্দ। কোনো শব্দ যখন বিভক্তিযুক্ত হয়ে পদে পরিণত হয় তখনই তা বাক্যে বসার যোগ্যতা অর্জন করে।

যদি আমরা কতকগুলি শব্দ দিয়ে বাক্য গঠন করি তবে তা কীরূপ হবে দেখা যাক – গাছ গাছ ফুল, ফুল ফুল অলি। এ রকমটা বললে মনের ভাবটি ঠিক মতো প্রকাশ পায় না। বাক্য গঠনের শর্তও মাটি হয়ে যায়। কেননা এখানে বাক্য গঠনের চেস্টা করা হয়েছে কেবল শব্দ দিয়ে। কিন্তু আমরা ঐ শব্দগুলির সঙ্গে যদি বিভক্তি যুক্ত করে দিই তাহলেই একটা সুন্দর বাক্য গঠিত হয়, প্রকাশ পায় মনের ভাব সার্থকভাবে। কী রকম ?

গাছ + এ (বিভক্তি)
গাছ + এ (বিভক্তি)
ফুল + শূন্য (বিভক্তি)
ফুল + এ (বিভক্তি)
ফুল + এ (বিভক্তি)
অলি + শূন্য (বিভক্তি)
অর্থাৎ “গাছে গাছে ফুল, ফুলে ফুলে অলি’ – এবার বাক্য গঠনের শর্তটি পূর্ণতা পায় এবং মনের ভাব প্রকাশে তা সহায়ক হয়ে ওঠে। এই যে প্রতিটি শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যোগ করে আমরা যা পেলাম (যেমন – গাছে, ফুলে, অলি ইত্যাদি) এইগুলিই হল পদ। বিভক্তিহীন পদগুলি শব্দ।

শব্দের শ্রেণিবিন্যাস

শব্দকে আমরা দুইভাবে ভাগ করে দেখাতে পারি। গঠনগত দিক থেকে শব্দকে আমরা দুটি শ্রেণিতে ভাগ করব – মৌলিক শব্দ এবং সাধিত শব্দ। আবার সাধিত শব্দগুলিকেও অর্থগত বিচারে আমরা তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করব – যৌগিক শব্দ, রূঢ় শব্দ এবং যোগরূঢ় শব্দ।

মৌলিক শব্দ

মৌলিক শব্দ হল সেই সমস্ত শব্দ যাদের বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না। যেমন – নাক, কান, এক, দুই, না ইত্যাদি। বেশ কিছু উপসর্গ আছে যেমন পরা, অপ্‌, নি এগুলিও মৌলিক শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়।

সাধিত শব্দ

এই ধরনের শব্দগুলিক বিশ্লেষণযোগ্য এবং সমাস দ্বারা নিষ্পন্ন অথবা প্রত্যয় যোগে গঠিত হয়। যেমন – সলজ্জ, ঘরোয়া, চলন ইত্যাদি। এই জাতীয় শব্দগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এগুলির কোনোটি সমাসবদ্ধ কিংবা প্রত্যয় যোগে গঠিত হয়েছে।

যৌগিক শব্দ

এটি এক প্রকারের সাধিত শব্দ। এই সকল শব্দের নিজস্ব অর্থ এবং প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের মিলিত অর্থের মধ্যে সমতা থাকে। অন্যভাবে এও বলা যেতে পারে যে, যৌগিক শব্দের অর্থ প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের মিলিত অর্থ থেকে পাওয়া যায়।
যেমন – নাচিয়ে’ শব্দটির অর্থ হল যে নাচে দক্ষ। এখন শব্দটির প্রকৃতি হল – নাচ্‌ ধাতু এবং প্রত্যয় হল ইয়ে। ‘নাচ্‌’ ধাতু অর্থে নাচ করা আর ‘ইয়ে’ অর্থে পটু বা দক্ষ। তাহলে এই প্রকৃতি আর প্রত্যয়ের মিলিত অর্থ নাচে পটু বা দক্ষ। আবার ‘নাচিয়ে’ শব্দটির অর্থ হল নাচে দক্ষ বা পটু। অতএব ‘নাচিয়ে’ একটি যৌগিক শব্দ। এরকম করণীয়, জলজ, বাঁদরামি ইত্যাদি

রূঢ় শব্দ

এটিও এক প্রকারের সাধিত শব্দ যা প্রকৃতি প্রত্যয়জাত অর্থ বহন না করে কেবল প্রচলিত অর্থ বহন করে।
যেমন – মণ্ডপ শব্দটি। শব্দটির প্রকৃতি প্রত্যয়জাত অর্থ হল মন্ড পান করে যা বা যে। কিন্তু শব্দটি প্রচলিত অর্থে দেবস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ শব্দটির প্রকৃতি প্রত্যয়জাত অর্থ এবং তার প্রচলিত অর্থে ভিন্নতা আছে। এরকম কুশল, হরিণ, প্রবীণ রূঢ় শব্দের উদাহরণ।

যোগরূঢ় শব্দ

এটিও এক প্রকারের সাধিত শব্দ যা প্রকৃতি প্রত্যয়জাত অর্থগুলির মধ্যে একটি বিশিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন – পঙ্কজ শব্দটি। পঙ্কজ শব্দের প্রকৃতি প্রত্যয়জাত অর্থ হল পঙ্কে বা পাঁকে জন্মায় যা। এখন পাঁকে যা কিছুই জন্মায় তা সবগুলি না বুঝিয়ে কেবল একটি (পদ্ম) অর্থকেই বোঝায়। এরকম বাঁশি, জলদ প্রভৃতি যোগরূঢ় শব্দের উদাহরণ।