পাঁচমিশালী

বাংলা সাহিত্যের টুকিটাকি

বাংলা সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য। সেই সমস্ত তথ্য আমরা নানা কারণে এড়িয়ে যাই, কিংবা আমাদের চোখে পড়ে না। সেইসব ছোট ছোট অথচ মূল্যবান তথ্যগুলি আমরা এখানে তুলে ধরার প্রয়াসী। একঝলক দেখে নেওয়া যাক বাংলা সাহিত্যের টুকিটাকি তথ্যগুলিকে।

টুকিটাকি ১ – বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “আম আঁটির ভেঁপু” ছোটদের জন্য স্বতন্ত্রভাবে রচিত কোন পৃথক উপন্যাস নয়। তাঁর “পথের পাঁচালি” উপন্যাসের একটি অংশের নাম। মূলত বালক অপু আর তার দিদি দুর্গার দিনগুলি এই অংশের মূল উপজীব্য। পরবর্তীকালে ১৯৪৫ খ্রিঃ অংশটিকে কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে স্বতন্ত্র কিশোর উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশকালে গ্রন্থটির প্রচ্ছদ তৈরী করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।

টুকিটাকি ২ – মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে নিয়ে কিংবা তাঁর দিল্লীর সিংহাসন দখল নিয়ে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয়েছে বেশ কিছু রচনার। যেমন –
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’ নাটক, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘রাষ্ট্রবিপ্লব’, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘ছায়াপথ’। আওরঙ্গজেব চরিত্রের প্রতি টান বশত সৃষ্টি হয়েছিল বংকিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’। রমেশচন্দ্র দত্ত সৃষ্টি করেছিলেন ‘মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ লিখেছিলেন তাঁর নাটক ‘আলমগীর’।

টুকিটাকি ৩ – মন্বন্তর

আমাদের এই বাংলায় ১১৭৬ ও ১৩৫০ সালে দুবার ভয়ানক মন্বন্তর হয়ে গেছে। অভাব, মৃত্যু যেকোন সংবেদনশীল মানুষকেই নাড়া দিয়ে যায়। আর যদি তিনি কোন কবি সাহিত্যিক হন তাহলে তাদের কোন না কোন রচনায় সেই প্রভাব পড়ে। দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রচনার অভাব নেই। কোন কোন রচনা ? সংক্ষেপে সেসব রচনার পরিচিতি দেখে নেওয়া যাক। যেমন –

তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন –
গণদেবতা (১৯৪২, উপন্যাস, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। মোট পরিচ্ছেদ সংখ্যা ২৮। মহামারী, দুর্ভিক্ষ, রাজনীতি, মানুষের উপর অত্যাচার ইত্যাদি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় অবলম্বনে রচিত এই উপন্যাস। উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল দেবু ঘোষ, গিরীশ, হরেন, দ্বারকা, অনিরুদ্ধ, পদ্ম, ছিরু পাল)

বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেছেন –
‘অশনি সংকেত’ (১৯৫৯, উপন্যাস, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। উপন্যাসের পটভূমিতে আছে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ। উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল গঙ্গাচরণ, অনঙ্গ)

শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এই পটভূমিতেই লিখেছেন –
‘মাটির মায়া’ (১৯৪৩, নাটক, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, নাটকের পটভূমিতে আছে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ। মূল চরিত্রগুলি হল মাধব, মল্লিকা, অরবিন্দ)

বংকিমচন্দ্র লিখেছেন –
আনন্দমঠ (১৮৮২, উপন্যাস, বঙ্কিমচন্দ্র। উপন্যাসের পটভূমিতে আছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। কাহিনীর খন্ড সংখ্যা ৪। মোট পরিচ্ছেদ সংখ্যা ৪৬ টি। মূল চরিত্রগুলি হল ভবানন্দ, জীবানন্দ, মহেন্দ্র, ধীরানন্দ)

বিজন ভট্টাচার্যের লেখা –
‘নবান্ন’ (১৯৪৪, নাটক, বিজন ভট্টাচার্য, পঞ্চাশের মন্বন্তর, আগষ্ট আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত নাটক। অঙ্ক সংখ্যা ৪। চরিত্রগুলি হল কুঞ্জ, নিরঞ্জন, দয়াল মন্ডল, নির্মল, রাধিকা)

‘আগুন’ (১৯৪৩, একাঙ্ক, বিজন ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের পরবর্তী খাদ্যাভাব পূরণে রেশন ব্যবস্থার প্রচলন এবং সেই ব্যবস্থায় মানুষের নানা বিভ্রান্তি এই নাটকের বিষয়। দৃশ্য সংখ্যা ৫)

তুলসী লাহিড়ীর রচনা –
‘ছেঁড়া তার’ (১৯৫২, নাটক, তুলসী লাহিড়ী, পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত নাটক। নাটকে রংপুরের কথ্যভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। মূল চরিত্রগুলি হল রহিমুদ্দি, হাকিমুদ্দি, ফুলজান)

টুকিটাকি ৪ – মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প

সব মিলিয়ে মাণিক বাবুর গল্প সংখ্যা ২২৩। তিনি তার গল্পের অনেক কাহিনীই নিয়েছেন তারই বিভিন্ন উপন্যাস থেকে। সব থেকে বেশি গ্রহণ করেছেন ‘আরোগ্য’, ‘হলুদ নদী সবুজ বন’ উপন্যাস থেকে। কোন গল্পের কাহিনী কোন উপন্যাস থেকে এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক –

মাটির মাশুল – ইতিকথার পরের কথা
লেভেল ক্রসিং – আরোগ্য
বাহিরে ঘরে – সার্বজনীন
মীমাংসা – পাশাপাশি
শিল্পী – আরোগ্য
স্টুডিও – আরোগ্য
রত্নাকর – তেইশ বছর আগে ও পরে
বড়দিন – হলুদ নদী সবুজ বন
সশস্ত্র প্রহরী – হলুদ নদী সবুজ বন
ভোঁতা – পাশাপাশি
মতি গতি – প্রাণেশ্বরের উপাখ্যান
কলমে হরফ – হরফ
দুর্ঘটনা – শান্তিলতা

এরকম অনেক গল্পই আছে যার কাহিনী বিভিন্ন উপন্যাস থেকে গৃহীত। অন্যদিকে আবার মাণিক বাবুর সুপরিচিত ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাস পৃথক তিনটি গল্পের (একটি দিন, একটি সন্ধ্যা ও রাত্রি)  উপন্যাস রূপ।

টুকিটাকি ৫ শিক্ষা, শিক্ষকতা ও শিক্ষক জীবন নিয়ে নানা সময় রচিত নানা রচনা।

রচনাগুলির প্রকাশকাল, রচয়িতার নাম এবং সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল।

১] গোত্রান্তর (১৯৫৭, নাটক, বিজন ভট্টাচার্য। উদ্বাস্তু এক শিক্ষক কিভাবে বস্তির শ্রমিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর কাহিনী এই নাটক। চরিত্রগুলি হল হরেন, গৌরী, কানাই)

২] গুরুদক্ষিণা (১৯৬৬, উপন্যাস, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। উপন্যাসটি শিক্ষা, শিক্ষক ও ছাত্র সম্পর্ক নিয়ে রচিত। সমকালীন শিক্ষা জগত ও স্কুল শিক্ষকদের দারিদ্যও দেখানো হয়েছে উপন্যাসে। উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল রামজয়, জিয়াউদ্দিন, রামরতন, মৃগাঙ্ক, ব্রজ, সীতেশ)

৩] মানুষ গড়ার কারিগর (১৯৭৩, উপন্যাস, মনোজ বসু। পরিচ্ছেদ সংখ্যা ২৫। শিক্ষক জীবন, শিক্ষকদের দুরবস্থা, দারিদ্র্যকে অবলম্বন করে রচিত এই উপন্যাস। উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল মহিম, করালীকান্ত, রামকিংকর, সলিলবাবু, গঙ্গাধর)

৪] শতাব্দীর মৃত্যু (? উপন্যাস, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষা ও শিক্ষকতা নিয়ে রচিত এই উপন্যাস। সংস্কৃত ও ইংরেজি দুই শিক্ষার প্রসঙ্গসহ সমকালীন বাংলার সামাজিক ইতিহাস আছে। উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল জ্যোতিপ্রসাদ, গোপীনাথ, কাদম্বরী, কৃষ্ণভামিনী)

৫] সন্দীপন পাঠশালা (১৯৪৬, উপন্যাস, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। মোট পরিচ্ছেদ সংখ্যা ১৭। শিক্ষা ও শিক্ষকজীবন কেন্দ্রিক একটি উপন্যাস। পাঠশালার প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে চলার আগ্রহের কথা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল সীতারাম, ধীরানন্দ, রমানাথ, মণি)

৬] হরিপদ মাষ্টার (১৯৫৮, নাটক, সুনীল দত্ত, বঞ্চিত শিক্ষক জীবনের কাহিনী নিয়ে রচিত নাটক। কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিপদ)

৭] রামমোহন (১৯৫৯, জীবনীনাটক, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, সতীদাহ নিবারণ ও ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তনে রামমোহনের যে লড়াই তা দেখানো হয়েছে এই নাটকে। অঙ্ক সংখ্যা ৪। চরিত্রগুলি হল রামমোহন, ডেভিড হেয়ার, মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ)

৮] বর্ণপরিচয় (১৯৬১, নাটক, সুনীল দত্ত, বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাদর্শ তথা সমাজকল্যাণের দিক তুলে ধরা হয়েছে এই নাটকে)

টুকিটাকি ৬ কালিদাস ও বাংলা সাহিত্য

ধ্রুপদী কবি নাট্যকার মহাকবি কালিদাস সম্পর্কে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নেই। বারে বারে বাংলা ভাষা সহ অন্যান্য অনেক ভাষাতেই তাঁর রচনা অনূদিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর জীবন নিয়ে কোন উপন্যাস বিশেষ একটা দেখা যায়নি। বাংলা সাহিত্যে সেই কাজটি করেছেন ব্যোমকেশ স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। শরদিন্দুর সাহিত্যের একটি বিশেষ দিক হল ঐতিহাসিকতা এবং প্রাচীন প্রসঙ্গ। তিনি নিজেই জানিয়েছেন “মহাকবি কালিদাসের কোনও নির্ভরযোগ্য জীবনী নাই’। হয়তো এই ভাবনা থেকেই কালিদাসের জীবন অবলম্বনে তিনি রচনা করেছেন উপন্যাস ‘কুমারসম্ভবের কবি’। যদিও এই উপন্যাস তাঁরই ‘কালিদাস’ নামক চিত্রনাট্যের পরিবর্তিত উপন্যাস রূপ। নীচে উপন্যাসটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল –

কুমারসম্ভবের কবি (১৩৭০ব, উপন্যাস, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। মহাকবি কালিদাসের জীবনকথা বলা হয়েছে এই উপন্যাসে। কালিদাস সম্পর্কে প্রচলিত নানা কিংবদন্তীর সঙ্গে লেখক আপন কল্পনা মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন এই উপন্যাসের কাহিনী। কাহিনীর ঘটনাকাল খ্রিষ্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দী। কালিদাস ছাড়া অন্যান্য চরিত্রগুলি হল মালিনী, ভানুমতী, বিক্রমাদিত্য)

টুকিটাকি ৭ ‘বাংলা সাহিত্যে প্রিয়’

প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ (১৯৮০, কাব্য, পূর্ণেন্দু পত্রী)
‘প্রিয় রাজছত্রধারী’ (? কবিতা, দেবারতি মিত্র)
‘প্রিয়তমার প্রতি’ (? কবিতা, দেবেন্দ্রনাথ সেন)
প্রিয় প্রসঙ্গ (১৮৮৪, কাব্য, মানকুমারী বসু)
কাঁদো প্রিয় দেশ (১৯৭১, প্রবন্ধগ্রন্থ, অন্নদাশঙ্কর রায়)
প্রিয় বান্ধবী (১৯৩১, উপন্যাস, প্রবোধকুমার সান্যাল)
আমার প্রিয় সখি (১৯৬০, ছোটগল্পগ্রন্থ, সন্তোষকুমার ঘোষ)
প্রিয়জন (১৯৭৭, গল্পগ্রন্থ, দিব্যেন্দু পালিত)
‘প্রিয় সখী’ (? কবিতা, রাধারানী দেবী)

তথ্যদানে – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়, টার্গেট বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *