বৈষ্ণব পদাবলি

মরমী কবি জ্ঞানদাস – বিস্তারিত তথ্যের আলোকে

চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব পদকর্তাদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য জ্ঞানদাস। আমরা এই আলোচনায় পদাবলিকার জ্ঞানদাস সম্পর্কে নানা খুঁটিনাটি তথ্য পরিবেশন করব। আমাদের এই আলোচনায় পাঠক পাঠিকার উপকার হলে আমরা আনন্দ পাবো। তাই আলোচনাটি ভালো লাগলে কমেন্ট করবেন এই অনুরোধ রইল।

জ্ঞানদাস পরিচয়

যতটুকু জানা যায় জ্ঞানদাস ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার কাঁদরা গ্রামে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। নরহরি চক্রবর্তী ‘ভক্তিরত্নাকরে’ জ্ঞানদাস বন্দনায় লিখেছেন –

‘শ্রীবীরভূমেতে ধাম           কাঁদড়া মাঁদড়া গ্রাম
তথায় জন্মিলা জ্ঞানদাস।
আকুমার বৈরাগ্যেতে           রত বাল্যকাল হৈতে
দীক্ষা লৈলা জাহ্নবার পান।।’

তাছাড়া ‘ভক্তিরত্নাকরে’ একথাও লেখা হয়েছে –

‘রাঢ়দেশে কান্দরা নামেতে গ্রাম হয়।
যথায় মঙ্গল জ্ঞানদাসের আলয়।।’

এই কাঁদরা গ্রামে ‘জ্ঞানদাসের মঠ’ অবস্থিত এবং প্রতি বছর পৌষ মাসে পূর্ণিমায় তিন দিন ব্যাপী জ্ঞানদাসের স্মরণোৎসব পালিত হয়। জ্ঞানদাস নিত্যানন্দের ভক্ত ছিলেন এবং নিত্যানন্দ-পত্নী জাহ্নবা দেবীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। খেতুরী মহোৎসবে জ্ঞানদাস অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সেই সময়ে নিত্যানন্দ-গোষ্ঠীর নেতৃ স্থানীয়দের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিলেন।

জ্ঞানদাসের পদ

‘পদকল্পতরু’তে জ্ঞানদাসের ভণিতায় মোট ১৮৬টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে ১০৫টি পদ ব্রজবুলিতে লেখা আর বাকি ৮১টি পদ বাংলায় লেখা। জ্ঞানদাসের প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে পূর্বরাগ, অনুরাগ ও রূপানুরাগ পর্যায়ের পদে। লিরিকধর্মী প্রতিভায়, রোম্যান্টিক কাব্যবৈশিষ্ট্য ও আধুনিকতায় জ্ঞানদাস পদাবলি সাহিত্যে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক-স্বরূপ। রূপানুরাগ পর্যায়ের এই পদটি পাঠকের মনকে বিভোর করে তোলে –

 ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পিরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।’

অনন্ত বাসনার অনন্ত হাহাকার এই পদে যেভাবে ধরা পড়েছে তেমনটি সচরাচর সুলভ নয়। আবার হৃদয়ের প্রেমার্তি ব্যক্ত হয়েছে এই পদে –

‘রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।’

‘রূপের পাথারে আঁখি’ ডুবে যাওয়া এবং ‘যৌবনের বনে মন’ হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে প্রেমের অসীমতার প্রকাশ ঘটেছে।

কবি বৈশিষ্ট্য

জ্ঞানদাসের পদে আছে প্রকৃতি ও ঋতুর বর্ণনা যা প্রাক্‌-চৈতন্যযুগের পদকর্তাদের মধ্যে ছিল না। সকল ঋতুর মধ্যে বর্ষাই জ্ঞানদাসের মনকে গভীরভাবে দোলা দিয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যে জ্ঞানদাসের উল্লেখযোগ্য অবদান হল বংশীমূলক পদের সংযোজন। জ্ঞানদাসের পদ দেহকে আশ্রয় করে দেহাতীতের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।

উপনাম – চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য

জ্ঞানদাসের পদাবলি গ্রন্থ – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্ঞানদাসের পদাবলি প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে ৩৯৫টি পদ আছে।

শ্রেষ্ঠত্ব – রূপানুরাগ পর্যায়ের পদ রচনায়

সমালোচকের মূল্যায়ন

১. ‘যখন জ্ঞানদাস কৃত্রিম কবি-সংস্কারের চশমা আর ব্রজবুলির সাজসজ্জা ত্যাগ করিয়া রাখালি সুরে রাধাকৃষ্ণের সুখদুঃখের কথা শুনাইয়াছেন, তখনই তিনি পাঠকের মন লুঠ করিয়া লইয়াছেন, তখনই তিনি যথার্থ চণ্ডীদাসের উত্তরসাধক হইয়াছেন।’ (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)

২. ‘জ্ঞানদাস শেষ পর্যন্ত প্রেমের কবি।’ (শঙ্করীপ্রসাদ বসু, সমালোচক কবিকে রোম্যান্টিক কবি হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন)

৩. ‘জ্ঞানদাস শ্রেষ্ঠ গীতিকবি –শ্রেষ্ঠ কলা শিল্পী’ (ভূদেব চৌধুরী)

৪. ‘গোবিন্দদাসকে যদি আমরা মণ্ডনকলার শ্রেষ্ঠ কবি আখ্যা দিই তাহলে জ্ঞানদাসকে বলতে হবে সে যুগের শ্রেষ্ঠ রোমাণ্টিক কবি।’ (হীরেন চট্টোপাধ্যায়)

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *