বাংলা সাহিত্যবৈষ্ণব পদাবলি

বৈষ্ণব পদাবলীর পদকর্তা – কিছু তথ্য

প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা পদাবলী সাহিত্য। পদাবলী সাহিত্যের ধারায় বৈষ্ণব পদাবলীর কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই পদাবলী সাহিত্যগুলিতে যেমন কবির ভক্তিভাব প্রকাশিত তেমনি সমাজের নানা দিকও প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের এই আলোচনা মূলত বৈষ্ণব পদাবলীর কয়েকজন কবি সম্পর্কে।

বিদ্যাপতি

(১) সংক্ষিপ্ত পরিচয় — মিথিলারাজ শিব সিংহ এর সভাকবি বিদ্যাপতির জন্ম চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে । তাঁর তিরোভাব ঘটে পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আনুমানিক ১৪৬০ খ্রি এর কাছাকাছি। বিদ্যাপতি চৈতন্য পূর্ব পদকর্তা ।
(২) বিদ্যাপতির গ্রন্থ পরিচয়ঃ সময়কাল সহ
ভু পরিক্রমা (১৪০০ খ্রি কাছাকাছি) , পুরুষ পরীক্ষা (১৪১০), কীর্তি পতাকা (১৪১০), লিখনা বলী (১৪১৮), শৈব সর্বস্ব হার (১৪৩০ – ১৪৪০), গঙ্গা বাক্যা বলী (১৪৩০ – ১৪৪০), বিভাগসার (১৪৪০ – ১৪৬০), দান বাক্যা বলী (১৪৪০ – ১৪৬০), দুর্গা ভক্তি তরঙ্গিণী (১৪৪০ – ১৪৬০)
(৩) পদ সংখ্যা — রাধা কৃষ্ণের উল্লেখ আছে এমন পদ ৫০০ টিরও বেশী ।
(৪) অভিনব জয়দেব কেন বলা হয় ?
কারণ বিদ্যাপতির কাব্যে জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের প্রভাব আছে বিশেষত রাধা চরিত্র নির্মাণে জয়দেবের প্রভাব লক্ষিত হয়।
(৫) মৈথিলী কোকিল কেন বলা হয় ?
কারন মিথিলার এই কবি তার পদাবলীর সুমিষ্ট আবেদনে বাঙালি কাব্য পাঠকের মনকে সহজেই দ্রবীভূত করতে পারেন বলেই তাঁকে মৈথিলী কোকিল বলা হয়।

(৬) বিদ্যাপতি নিজেকে মধ্যযুগের ‘কবি সার্বভৌম’ ও ‘খেলন কবি’ বলেছেন তাঁর কীর্তি লতা কাব্যে।
(৭) বিদ্যাপতিকে বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্তির কারণ কী ?
মিথিলার কবি হলেও বিদ্যাপতি বাঙালির হৃদয় রাজ্যে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণ — মিথিলার সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা , বিদ্যাপতির ওপর জয়দেবের প্রভাব, তাঁর পদ চৈতন্য দেব কর্তৃক আস্বাদন এর জন্য।
(৮) বিদ্যাপতির শ্রেষ্ঠত্ব — বিদ্যাপতি জীবন রস রসিক যৌবনের কবি, প্রেমের কবি । তার পদে লৌকিক সংসারের প্রণয়াসক্ত নরনারীর মিলন বিরহের আর্তি ফুটে উঠেছে । রাধা চরিত্র নির্মাণে কবি তার মনস্তত্ব ও শিল্পঞ্জানের পরিচয় দিয়েছেন (৯) বিদ্যাপতি কোন ভাষায় পদ রচনা করেছেন?
ব্রজবুলি
(১০) ব্রজবুলি কোথাকার ভাষা ?
ব্রজবুলি কোন অঞ্চলের ভাষা নয়। বাংলা, মৈথিলী ও অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার সংমিশ্রণে এটি একটি কৃত্রিম লেখ্য ভাষা ।

পদকর্তা চন্ডীদাস

(১) চণ্ডীদাস সম্পর্কে কে প্রথম বিস্তারিত আলোচনা করেন?
রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর ‘বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থে
(২) চন্ডীদাসের জন্ম সম্পর্কে কি জানা যায় ?
চন্ডীদাসের জন্ম বীরভূমের নান্নুর গ্রামে। মতান্তরে বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে।
(৩) চন্ডীদাসের জীবনী বিষয়ক গ্রন্থ কে লেখেন ?
কৃষ্ণ প্রসাদ সেন । গ্রন্থটিকে যোগেশ চন্দ্র বিদ্যানিধি ১৩৪৪ এ প্রবাসী কার্যালয় থেকে প্রকাশ করেন ।
(৪) চন্ডীদাস যে চৈতন্য পূর্ববর্তী কবি তা কিভাবে বলা যায় ?
শ্রী চৈতন্য চরিতামৃতে আছে “বিদ্যাপতি চন্ডীদাস শ্রীগীতগোবিন্দ / এই তিন গীতে করায় প্রভুর আনন্দ’ । এ থেকেই বোঝা যায় চন্ডীদাস চৈতন্য পূর্ববর্তী কবি ।
(৫) চন্ডীদাসের শ্রেষ্ঠত্ব কোন শ্রেণীর পদ রচনায় ?
চন্ডীদাসের শ্রেষ্ঠত্ব আক্ষেপানুরাগের পদে । উদাহরণ — রাতি কইনু দিবস, দিবস কইনু রাতি / বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরিতি
(৬) কোন কাব্য আবিষ্কারের পর চন্ডীদাস সমস্যা জোরালো হয়ে ওঠে ?
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য

পদকর্তা জ্ঞানদাস

(১) সংক্ষিপ্ত পরিচয় — জ্ঞানদাস চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব পদকর্তা । তার জন্ম বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকট বর্তী কাঁদরা গ্রামে। আবির্ভাবকাল ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে মোটামুটি ১৫৩০ খ্রি। তিনি ব্রজবুলি ও বাংলা ভাষাতে পদ রচনা করেছেন । তবে তাঁর কৃতিত্ব যা কিছু তা বাংলা পদকে কেন্দ্র করেই ।
(২) পদ সংখ্যা — ‘পদ কল্পতরুতে জ্ঞানদাসের ভণিতাযুক্ত পদ পাওয়া যায় ১৮৬ টি। যার মধ্যে ব্রজবুলি পদ ১০৫ টি আর বাংলা পদ ৮১ টি।
(৩) জ্ঞানদাসকে কার ভাবশিস্য বলা হয় ?
চন্ডীদাসের

পদকর্তা গোবিন্দ দাস

(১) সংক্ষিপ্ত পরিচয় — গোবিন্দ দাস চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব পদকর্তা । তার জন্ম ষোড়শ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি প্রথম জীবনে শাক্ত ছিলেন পরে ৪০ বছর বয়সে শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন ।
(২) শাব্দিক কবি কেন বলা হয় ?
কারণ তাঁর পদে শব্দ ও অনুপ্রাসের ঝংকার আছে। যেমন – নন্দ নন্দন চন্দ চন্দন গন্ধ নিন্দিত অংগ
(৩) দ্বিতীয় বিদ্যাপতি বলার কারণ কি ?
কারণ দুই শতাব্দীর পর বিদ্যাপতি আবার নতুন করে বেঁচে উঠলেন গোবিন্দদাসের মধ্যে। তার মধ্যে পাওয়া গেল বিদ্যাপতির ভাব ও ভাষাকে । বিদ্যাপতির মতো তার কাব্যেও ব্রজবুলির ব্যবহার।
(৪) পদ সংখ্যা – প্রায় ৮০০টি
(৫) শ্রেষ্ঠ পর্যায় — অভিসার

(৬) নাটক – সঙ্গীত মাধব
(৭) গোবিন্দদাসকে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি কে বলেছিলেন ?
বৈষ্ণব পদকর্তা বল্লভ দাস ।
(৮) গোবিন্দদাসকে কবিরাজ উপাধি কে দিয়েছিলেন ?
এ নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন শ্রীনিবাস আচার্য আবার কেউ বলেন শ্রীজীব গোস্বামী
(৯) পদের বৈশিষ্ট্য — ঝংকার মুখর ব্রজবুলি ভাষার ব্যবহার , ছন্দের বিস্ময়কর কারুকাজ, চিত্র কল্পের প্রয়োগ, কল্পনা ও আবেগের সুনিপুণ প্রয়োগ
(১০) বৈষ্ণব পদাবলীর মুসলমান কবি — সৈয়দ মুর্তজা , নাসির মামুদ, আলিরাজা

বৈষ্ণব পদাবলী সংক্রান্ত আরো কিছু প্রশ্ন ও উত্তর 

(১) বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী কারা ?
সনাতন গোস্বামী, রূপ গোস্বামী, শ্রী জীব গোস্বামী, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ দাস, ও রঘুনাথ ভট্ট এদের একত্রে বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী বলা হয়।
(২) বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের লেখা গ্রন্থ–
সনাতন গোস্বামী – বৃহদ ভাগবতামৃত, হরিভক্তিবিলাস, বৈষ্ণব তোসণী
শ্রীরূপ গোস্বামী – হংসদূত উজ্জ্বল নীলমণি , ভক্তি রসামৃত সিন্ধু

(৩) মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের সংস্কৃত জীবনী কাব্যগুলি কি কি ?
মুরারী গুপ্তের “শ্রী শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য চরিতামৃত ‘ যা মুরারী গুপ্তের কড়চা নামে পরিচিত।
কবি কর্ণ পুর বা পরমানন্দ সেনের ‘চৈতন্য চরিতামৃত’, ‘চৈতন্য চন্দ্রোদয়, গৌর গণোদ্দেশ দীপিকা
প্রবোধানন্দ সরস্বতীর চৈতন্য চন্দ্রামৃত
স্বরূপ দামোদরের কড়চা
(৪) খেতুরী মহোৎসব কে কখন করেছিলেন ?
নরোত্তম ঠাকুর ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে বা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যে বৈষ্ণব সম্মেলনের আহ্বান করেন তাই খেতুরী মহোৎসব । খেতুরী বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী তে অবস্থিত।
(৫) বৈষ্ণব পদাবলীর শ্রেষ্ঠ সংকলন গ্রন্থের নাম কি ?
বৈষ্ণব পদাবলীর শ্রেষ্ঠ সংকলন গ্রন্থের নাম গোকুলানন্দ সেনের ‘পদ কল্পতরু’ । এখানে ১৪০ জন পদকর্তার তিন হাজারেরও বেশী পদ আছে।

তথ্যসূত্র – বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা, ভূদেব চৌধুরী, এসএসসি টার্গেট এসএলএসটি বাংলা

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষক, অ্যাডমিন, টার্গেট এসএসসি বাংলা