পাঁচমিশালী

অলংকার – বিশদ আলোচনা

টার্গেট বাংলার এই আলোচনায় আমরা অলংকার সম্পর্কে নানা খুঁটিনাটি তথ্য জেনে নেব। আমাদের আজকের আলোচনাটি অলংকার বিষয়ে প্রথম পর্ব। এই পর্বে আমরা অলংকার কী ?, অলংকার কত প্রকারের এবং সেই সমস্ত শ্রেণির অন্যতম শব্দালংকার সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ করে নেব। আলোচনাটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া আশা করি।

‘কান্ত কাতর কতহুঁ কাকুতি
করত কামিনী পায়’

বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতির লেখা উক্ত চরণটি পড়লে শব্দের ঝঙ্কার যেন ধ্বনিত হয় আমাদের কানে। কিংবা বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলে পরিচিত গোবিন্দদাসের লেখা ‘নন্দ নন্দন চন্দ চন্দন গন্ধ নিন্দিত অঙ্গ’ এক শ্রুতি মাধূর্য সৃষ্টি করে। কিন্তু কোন গুণে কোনো রচনা এমন শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে ?

উত্তর হল অলঙ্কার। হ্যাঁ, অলঙ্কার যেমন নারীদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তেমনি কাব্যেরও। এখন প্রশ্ন হল কাকে বলে অলঙ্কার ?

উত্তর হল, বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ যে সকল ভূষণের দ্বারা কাব্য রসোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে এবং সৌন্দর্য লাভ করে তাকেই অলঙ্কার বলে।

অলঙ্কার ও তার শ্রেণি

অলঙ্কার হয় মুখ্যত দুই প্রকার – শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার। এই দুই প্রকারের অলঙ্কার আবার আরও কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত। আমরা চিত্রের সাহায্যে অলঙ্কারের সম্পূর্ণ শ্রেণিবিন্যাসটি দেখে নেব। নীচের চিত্রটি দেখার অনুরোধ রইল –

শব্দালঙ্কারঃ

আলঙ্কারিকদের মতে, শব্দালঙ্কার ধ্বনির অলঙ্কার। কাব্যে শব্দালঙ্কারের ব্যবহারের ধ্বনির এক মাধূর্য সৃষ্টি হয়। আমরা প্রথমেই তার উদাহরণ দেখে নিয়েছি। অলঙ্কারের শ্রেণিবিন্যাসেও দেখেছি শব্দালঙ্কার চার প্রকারের হয়। এখন এই চার প্রকারের শব্দালঙ্কার সম্পর্কে আমরা জেনে নেব।

১. অনুপ্রাসঃ কাব্যে কোনো চরণে একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ একাধিকবার ব্যবহৃত হয়ে ধ্বনিত হলে তাকে অনুপ্রাস বলে। মনে রাখুন, অনুপ্রাসে প্রাধান্য পায় ব্যঞ্জনধ্বনি। যেমন –

‘গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে
গরজে গগনে।’

এই উদাহরণে ‘গ্‌’ ধ্বনিটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়ে শ্রুতিমাধূর্য সৃষ্টি করেছে। অতএব এখানে ‘গ্‌’ -এর অনুপ্রাস হয়েছে। অনুপ্রাসের নানা উদাহরণ নীচে দেওয়া হল –

অনুপ্রাসের উদাহরণ –

  • কেতকী কত কি কথা কামিনীর কহে কানে কানে
  • ঐ আসে ঐ অতিভৈরব হরষে
    জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে
    ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা।
  • রজনীগন্ধ্যা বাস বিলালো
    সজনী সন্ধ্যা আসবি না লো ?
  • ঝর্ণা ! ঝর্ণা ! সুন্দরী ঝর্ণা !
    তরলিত চন্দ্রিকা চন্দনবর্ণা।
  •  ধরা নাহি দিলে ধরিব দুপায়
    কি করিতে হবে বলো সে উপায়

২. শ্লেষঃ একটি শব্দের একবার মাত্র ব্যবহারে যদি দুটি অর্থ প্রকাশ পায় তবে তাকে শ্লেষ বলা হয়।

যেমন –                  কৃষ্ণসারের পায়          কেশরী করুণা চায়

                              তরল-আয়ত-আঁখি-পরসাদে মুগ্ধ।

এই উদাহরণে কৃষ্ণসার বলতে একপ্রকারের হরিণকে বোঝায়। আর কেশরী বলতে সিংহ। কিন্তু শব্দদুটির ভিন্ন অর্থ হল কৃষ্ণসার অর্থাৎ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য (কৃষ্ণের সার) এবং কেশরী অর্থাৎ বেদান্তকেশরী প্রকাশানন্দ সরস্বতী।

এরকম –

  • অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ (অতি বড় বৃদ্ধ = অত্যন্ত বুড়ো কিন্তু ভিন্নার্থে সর্বজ্ঞানী। সিদ্ধি = ভাঙ কিন্তু ভিন্নার্থে যুক্তি)
  • এনেছে তোমার স্বামী বাঁধি নিজগুণে (গুণ = স্বভাব কিন্তু ভিন্নার্থে ধনুকের ছিলা)
  • বাজে পূরবীর ছন্দে রবির শেষ রাগিণীর বীণ (পূরবী = রাগবিশেষ কিন্তু ভিন্নার্থে রবীন্দ্রনাথের কাব্য। রবি = সূর্য কিন্তু ভিন্নার্থে রবীন্দ্রনাথ)
  • কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠে ভরা বিষ (কণ্ঠে ভরা বিষ = কথায় বিষের জ্বালা কিন্তু ভিন্নার্থে নীলকণ্ঠ শিব)
  • কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর (ঈশ্বর = বিধাতা কিন্তু ভিন্নার্থে কবি ঈশ্বর গুপ্ত)

আরও পড়ুন

৩. যমকঃ দুটি বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি স্বরধ্বনি সহ নির্দিষ্ট ক্রমে সার্থক বা নিরর্থক ভাবে প্রযুক্ত হলে যমক অলঙ্কার হয়।

যেমন –                           ভারত ভারত খ্যাত আপনার গুণে

এই উদাহরণে একই ব্যঞ্জনধ্বনির পুনর্ব্যবহার হয়ে কাব্যের আঙ্গিকগত সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।

এরকম –

  • মনে করি করী করি কিন্তু হয় হয়
  • নিরমল নিরাকার নীরাকার নয়
  • চাহি না চাহিতে আর কারো প্রতি
  • আঁধারের কালি কালির লিখন একাকার করি দিল
  • প্রভাকর প্রভাতে প্রভাতে মনোলোভা

৪. বক্রোক্তিঃ বক্তা যে অর্থে কোনো কথা বলেন শ্রোতা যদি তা ভিন্নার্থে গ্রহণ করে তখন তাকে বক্রোক্তি বলা হয়। মনে রাখুন, এই অলঙ্কারে ইতিবাচক বাক্য নেতিবাচক বাক্যে এবং নেতিবাচক বাক্য ইতিবাচক বাক্যে বোঝানো হয়।

যেমন –                                কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ ?

প্রদত্ত উদাহরণে বাক্যটি ইতিবাচক। কিন্তু এর অর্থটি নেতিবাচক – কেউ পদ্মের পর্ণ ছেঁড়ে না।

এরকম –

  • কে কবে মঙ্গলঘট ভাঙে পদাঘাতে ?
  • নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায় ?
  • আজি হতে শতবর্ষ পরে
  • এ সুন্দর অরণ্যের পল্লবের স্তরে
    কাঁপিবে না আমার পরাণ ?
  • ক্ষীণ শিশুটিরে স্তন্য দিয়ে বাঁচাইয়ে
    তোলে মাতা, সে কি তার রক্তপানলোভে ?
  • তবু বারুদের গন্ধ এখানের বাতাসে কি নাই ?

যদি পাঠক-পাঠিকা এই আলোচনায় উপকৃত হন তবে আমরা দ্বিতীয় পর্বে অর্থালংকার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেব।

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *