চণ্ডীমঙ্গল কাব্য

চন্ডীমঙ্গল কাব্যকাহিনী

চন্ডীমঙ্গল কাব্য প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্যের ধারায় একটি অন্যতম অধ্যায়। দেবী চন্ডিকার স্বরূপ এবং মর্ত্যে তাঁর পূজা প্রচার তথা দেবী চন্ডীর মহিমা কীর্তনই এই কাব্যের মুখ্য বিষয়। কিন্তু সাহিত্য হিসেবেও আছে এর বিশেষ মূল্য। আমাদের এই আলোচনায় মুখ্যত প্রাধান্য পেয়েছে চন্ডীমঙ্গল কাব্যকাহিনী ।

চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী মূলত দুটি। কালকেতু – ফুল্লরা কাহিনি যা “আখেটিক খন্ড” এর অন্তর্গত। এবং ধনপতি- খুল্লনা-লহনা কাহিনি যা “বণিক খন্ড” নামে পরিচিত।

চন্ডীমঙ্গল কাব্যকাহিনী (আখেটিক খন্ড)

দেবী চন্ডী অসীম শক্তির অধিকারিণী ও বরাভয়দাত্রী। মর্ত্যে পূজা প্রচার দেবী চন্ডীর প্রধান উদ্দেশ্য। অন্যদিকে সংসারে দেবী চন্ডীর সঙ্গে শিবের প্রতিনিয়তই বিরোধ। তাই দেবী চন্ডী সখী পদ্মার পরামর্শে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরের মাধ্যমে মর্ত্যে পূজা প্রচার করবেন ঠিক করলেন। একদিন ইন্দ্র পুত্র নীলাম্বর ফুল তোলার জন্য নন্দনকাননে যান সেখানে গিয়ে তিনি আশ্চর্য হয়ে যান, দেখেন সেই কাননে কোনো ফুল নেই। নীলাম্বর ফুলের সন্ধানে মর্ত্যলোকে যান। এই সময় দেবী চন্ডী এক ফুলের মধ্যে আত্মগোপন করে রইলেন এবং ইন্দ্রের শিব পূজার সময় ফুলের কীটরুপে শিবকে দংশন করেন। শিব তখন নীলাম্বরকে মর্ত্যে ব্যাধসন্তান রুপে জন্মাবার অভিশাপ দেন। এই স্বর্গভ্রষ্ঠ নীলাম্বরই মর্ত্যে ব্যাধ ধর্মকেতুর পুত্র কালকেতু রুপে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার পত্নী ছায়া সঞ্জয় ব্যাধের কন্যা ফুল্লরা রুপে জন্মগ্রহণ করেন।

দিনে দিনে কালকেতু বড়ো হয়ে উঠতে থাকে। অসীম তার পরাক্রম।পশুরা কালকেতুর ভয়ে ত্রস্ত,ভীত হয়ে উঠল।বিপন্ন পশুরা দেবী চন্ডীর কাছে বরাভয় প্রার্থনা করল। দেবী অভয় দান করলেন। একদিন দেবী সমস্ত পশুদের লুকিয়ে রেখে নিজে স্বর্ণ গোধিকার ছদ্মবেশে বনে কালকেতুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কালকেতু শিকারে এসে কোনো পশুকে দেখতে পেলেন না সামনে স্বর্ণ-গোধিকা দেখতে পেয়ে তাকে ধনুকের ছিলায় বেঁধে বাড়ি ফিরলেন। শিকারের এই অবস্থা দেখে হতাশ ফুল্লরা মনের দুঃখে প্রতিবেশির বাড়িতে গেলেন খুদ ধার করতে এবং কালকেতু মাংস বিক্রি করবার জন্য হাটে গেলেন।

আরো পড়ুন

প্রতিবেশির কাছ থেকে ফিরে এসে ফুল্লরা গোধিকাকে দেখলেন এক অপূর্ব রমণীরুপে । ফুল্লরা তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করাতে ছদ্মবেশে চন্ডী বলেন,তাঁর ইচ্ছা তিনি ফুল্লরার সতীন হয়ে থাকেন এবং তাদের পরিবারের দুর্গতি বিনাশ করেন। ফুল্লরা ছদ্মবেশিনী দেবী চন্ডীকে তার স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে বলেন এবং তাকে নানা ভাবে তিরস্কার করতে থাকে। অবশেষে ফুল্লরা বাজারের বেরিয়ে যায় স্বামী কালকেতুর সন্ধানে । কালকেতু এই খবর শুনে হতবাক হন। কালকেতু ছদ্মবেশি দেবীকে অন্যত্র চলে যাবার জন্য বুঝিয়ে বলেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় কালকেতু ধনুকে শর যোজন করেন কিন্তু সেই শর তার নিজের অবস্থানেই স্থির থাকে।এর পর দেবী নিজ মূর্তি ধারন করেন এবং কালকেতুকে সাত ঘড়া ধন দিয়ে গুজরাট নগরে রাজ্য স্থাপন করতে বলেনএবং তাঁর পূজার নির্দেশ দেন।

দেবী প্রদত্ত সাত ঘড়া ধন ও বহুমূল্য আংটি গ্রহণ করে কালকেতু সেই আংটি ভাঙাতে গেলে বণিক মুরারি শীলের কাছে প্রতারিত হবার মুহুর্তে দৈব্যবাণী হওয়ায় মুরারি শীল কালকেতুকে আংটির উচিত মূল্য ফিরিয়ে দেন। এরপর কালকেতু দেবীর কথা মতো বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন করেন । হিন্দু – মুসলমান নির্বিশেষে নানা জাতির বসতি গড়ে ওঠে । এর মধ্যে ভাঁড়ু দত্ত নামে এক ধূর্ত কায়স্থ সন্তান ছিল। ভাঁড়ু দত্ত গুজরাট নগরে নানান অত্যাচার শুরু করলে প্রজারা কালকেতুর কাছে নালিশ জানাতে আসে। কালকেতু ভাঁড়ুকে রাজ্য থেকে বিতারিত করেন। প্রতিহিংসা পরায়ণ ভাঁড়ু পার্শ্চবর্তী রাজ্য কলিঙ্গরাজকে কালকেতুর সঙ্গে যুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।

কলিঙ্গরাজের সঙ্গে যুদ্ধে কালকেতু পরাজিত হন এবং তিনি বন্দী হন। কলিঙ্গের কারাগারে অশেষ দুঃখ পেয়ে তিনি দেবী চন্ডীর স্মরণাপন্ন হন। কলিঙ্গরাজ্যে প্রচন্ড বন্যা হল, দেবী কলিঙ্গরাজকে স্বপ্ন দিলেন। কালকেতু দেবী চন্ডীর বরপুত্র জেনে কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে মুক্তি দিলেন। রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন। কালকেতু রাজ্য ফিরে পেয়ে ভাঁড়ুকে যথোচিত শাস্তি দিলেন। কালকেতু দেবী চন্ডীর মহাসমারোহে পূজা করলেন। পরম শান্তিতে দীর্ঘকাল রাজ্য শাসনের পর কালকেতু ও ফুল্লরা পুত্রকে রাজ্যভার দিয়ে নীলাম্বর ও ছায়া রুপে ইন্দ্রের রথে চেপে স্বর্গে ফিরে গেলেন। দেবী চন্ডীর পূজা মর্ত্যে প্রচার হল।

বণিক খন্ড : ধনপতির উপাখ্যান

ধনপতি সদাগর ছিলেন উজানী নগরের বিখ্যাত বণিক। তিনি ছিলেন শৈব। অর্থ কৈলীন্যের দিক থেকে ধনপতি বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উঁচু স্থানে ছিল তাই দেবী চন্ডী ধনপতিকে দিয়ে পূজা প্রচারে উদগ্রীব হন। দেবী তার ইচ্ছা চরিতার্থের জন্য স্বর্গের নর্তকী রত্নমালাকে শাপ দিয়ে মর্ত্যে পাঠান। এই রত্নমালা মর্ত্যে খুল্লনা নামে পরিচিত হন। ধনপতির দুই স্ত্রী – লহনা ও খুল্লনা। লহনা সন্তানহীনা হওয়ায় খুল্লনাকে বিবাহ করেন। এতে লহনা খুল্লনার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়। দ্বিতীয় বিবাহের পর ধনপতিকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে দূরদেশ গমন করতে হয়। খুল্লনার দেখাশোনার ভার দিয়ে যান লহনার উপর। এই সুযোগে লহনা খুল্লনার উপর নির্যাতন শুরু করে।

এই কাজে তাকে সাহায্য করে তার দাসী দুর্বলা। স্বামীর নামে এক জাল চিঠি দেখিয়ে লহনা খুল্লনাকে জানায় যে তার স্বামী তাকে ছাগল চড়াতে এবং ঢেঁকিশালে শয়ন করতে নির্দেশ দিয়েছে।সেই নির্দেশ মেনে নেয় খুল্লনা। বনে বনে ছাগল চড়িয়ে, ঢেঁকিশালে রাত কাটিয়ে, সতীনের নানা অত্যাচার সহ্য করতে করতে তার দিন কাটতে লাগল। তিনি স্মরণাপন্ন হলেন দেবী মঙ্গলচন্ডীর।। ব্রত পালন করলেন।

আরো পড়ুন

এরপরে ধনপতি ফিরে এলেন, খুল্লনার উপর লহনার অত্যাচার শুনে তাকে ভৎসনা করলেন। অন্যদিকে খুল্লনার গর্ভে দেবী চন্ডী মালাধরকে স্বর্গভ্রষ্ট করে সন্তান রুপে জন্মগ্রহণের নির্দেশ দিলেন। ধনপতি সিংহল যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন।স্বামীর মঙ্গল কামনায় খুল্লনা দেবী চন্ডীর ঘট স্থাপন করে পূজা শুরু করেন। শিবের উপাসক ধনপতি চন্ডীর ঘট দেখে ক্ষুদ্ধ হয়ে ঘট লাথি মেরে ফেলে দেয়। দেবী ক্রোধান্বিত হন।ধনপতির সিংহল যাত্রায় ছয় ডিঙা জলমগ্ন করে দেন। ধনপতি প্রামে বেঁচে যান। কালীদহে ধনপতি কমলে কামিনী দৃশ্য দেখেন। ধনপতি সিংহল রাজাকে এই দৃশ্যের কথা বলেন। রাজাধনপতিকে বলেন যদি এই দৃশ্য আর একবার দেখাতে পারেন তাহলে অর্ধেক রাজত্ত্ব দান করবেন, না হলেতাকে যাবজ্জীবন কারাবাস করতে হবে। ধনপতি স্বীকৃত হলেন। চন্ডীর ছলনায় তিনি রাজাকে সেই দৃশ্য দেখাতে না পারায় তাকে কারারুদ্ধ হতে হয়। শিবোপাসক ধনপতিকে স্বপ্নে দেবী চন্ডীর নিজের পূজা প্রচারের কথা বললে তিনি অসম্মত হন।

অন্যদিকে খুল্লনার গর্ভজাত পুত্র শ্রীমন্ত বড়ো হতে লাগল। বিদ্যার্জন করল। পাঠাশালায় গুরুমশাই তার পিতৃবৃত্তান্ত জানতে চাইল। মায়ের কাছে সব শুনে পিতার খোঁজে সপ্তডিঙা নিয়ে সিংহল যাত্রা করলেন। সেই কমলেকামিনী দেখল। শ্রীমন্ত রাজার কাছে প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য না দেখাতে পারায় মশানে তার শিরচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হল। এই সময় শ্রীমন্ত মাতার নির্দেশ অনুযায়ী দেবী চন্ডীর স্তব আরম্ভ করে। ব্রাহ্মণীর বেশে দেবী চন্ডী শ্রীমন্তকে উদ্ধার করেন। সিংহল রাজের সৈন্য ধ্বংশ হয়। রাজা সমস্ত বিষয়ে অবগত হয়ে পিতা পুত্রকে মুক্ত করেন এবং রাজকন্যা সুশীলার সঙ্গে শ্রীমন্তের বিবাহ দেন। ধনপতি পুত্র ও পুত্রবধূ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।দেবী চন্ডীর পূজা শুরু হয়। স্বর্গভ্রষ্ট রত্নমালা ও মালাধর স্বর্গে ফিরে যান।

গ্রন্থসূত্র : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- ড. দেবেশ কুমার আচার্য্য

আলোচক – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *