গীতিকা সাহিত্য

গীতিকা সাহিত্য – একটি পর্যালোচনা

গীতিকা সাহিত্য – একটি পর্যালোচনা । এই আলোচনায় গীতিকা সাহিত্য সম্পর্কে নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের ব্যালাডধর্মী রচনা হল গীতিকা। Ballad শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Ballare শব্দ থেকে।এর অর্থ হল নৃত্য।অর্থাৎ নৃত্য গীত মুলক রচনা হল গাথা বা গীতিকা। দীনেশ চন্দ্র সেন ও আশুতোষ ভট্টাচার্য Ballad শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে গীতিকা শব্দটি ব্যাবহার করেছেন।

গীতিকার চারটি উপাদান – ক্রিয়া, চরিত্র, উপস্থাপন, বিষয়।

বাংলায় তিন প্রকার গীতিকা পাওয়া যায়। ১) নাথ গীতিকা ২) ময়মনসিংহ গীতিকা ৩) পূর্ববঙ্গ গীতিকা।

নাথ গীতিকা- নাথ সিদ্ধাচার্য দের কাহিনী নিয়ে রচিত গাথাই হল নাথ গীতিকা।শ্রেষ্ঠ নাথ সিদ্ধাচার্যাগন যথা-মীন নাথ,গোরক্ষনাথ,হাড়িপা,কানুপা,ময়নামতি প্রমুখ। এরা দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে আবির্ভূত হন বলে অনুমান করা হয়। নাথ গীতিকা উন্মোচনের সঙ্গে জর্জ গ্রিয়ারসনের নাম জড়িত। তিনি সর্বপ্রথম রংপুরে অবস্থান কালে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে মানিক চন্দ্র রাজার গান(The song of manikcandra) নাম দিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়েই গীতিকা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটে।

শ্রেণিবিন্যাস

নাথ গীতিকার দুটি শ্রেণি – গোরক্ষবিজয় বা মীনচেতন কেন্দ্রিক গীতিকা এবং মানিক চন্দ্র রাজার গান, গোবিন্দ চন্দ্রের গীত বা ময়নামতির গান।

১) গোরক্ষবিজয় বা মীন চেতন-বাংলা সাহিত্যে মীনচেতন কাহিনী সর্বপ্রথম দেখা যায় অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত সহদেব চক্রবর্তী এবং দ্বিজ লক্ষনের “অনিল পুরাণ”এ। গোরক্ষবিজয় কাব্যের আদি কবি -শেখ ফয়জুল্লা।মুন্সি আব্দুল করিম ১৯১৭ খ্রি গৌরক্ষবিজয় নাম দিয়ে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। গোরক্ষবিজয় কাব্যের প্রাচীনতম পুথির লিপিকাল-১৭৭৭ খ্রি। নলীনীকান্ত ভট্টশালী-শ্যমদাস সেনের মীনচেতন ১৯১৫ খ্রি প্রকাশিত।
গোরক্ষবিজয় কাব্যের গ্রন্থের ভনিতায়-ভীমসেন রায়, ভীমদাস,শ্যামদাস সেন, কবিচন্দ্র দাস,শেখ ফয়জুল্লা প্রমুখ কবিদের ভনিতা পাওয়া যায়।
চরিত্র – কমলা,মঙ্গলা, গোরক্ষনাথ, মীননাথ, গৌরী।

২) মানিকচন্দ্র রাজার গান বা ময়নামতির গান- আদি কবি দুর্লভ মল্লিক। অন্যান্য কবিদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল-ভবানী দাস, সুকুর মামুদ। প্রাচীন পুথি ১৭৯৯খ্রী রচিত। শিবচন্দ্র শীল ১৩০৮ সালে গোবিন্দ চন্দ্রগীত নামে প্রকাশ করেন।
গোপীচন্দ্র এর আখ্যান ৫টি খন্ডে বিভক্ত – জন্ম খন্ড, বুঝান খন্ড, পন্ডিত খন্ড, মুন্ডন খন্ড ও সন্ন্যাস খন্ড।
চরিত্র – মানিকচন্দ্র, গোপীচাঁদ,ময়নামতি, অদুনা, পদুনা, হীরানটি, খেতু।

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, রংপুর, ও বিভিন্নস্থানে অর্ধশিক্ষিত কবিরা নরনারীর প্রেম, জমিদারের রেষারেষি প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে মুখে মুখে এক শ্রেণির আখ্যান জাতীয় পালা রচনা করতেন। ছড়া পাঁচালীর ঢঙে রচিত পালা গুলিকেই ময়মনসিংহ গীতিকা বলা হয়।

সংগ্রাহক পরিচিতি

গীতিকা সাহিত্য -এর আলোচনায় ময়মনসিংহ গীতিকা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ময়মনসিংহ গীতিকা আবিষ্কারের সঙ্গে চন্দ্রকুমার দের নাম জড়িত। তিনি ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কেদারনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় মালীর যোগান নামক নিবন্ধে “মহিলা কবি” চন্দ্রাবতী বিষয়ক আলোচনা প্রসঙ্গে পালার কথা উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে দু একটি পালা এখানে প্রকাশ করেন। সেখান থেকেই ময়মনসিংহ গীতিকা শিক্ষিত সমাজে প্রচার লাভ করে।
বঙ্গসাহিত্যের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব দীনেশচন্দ্র সেন আগ্রহী হয়ে ১৯১৯ খ্রি চন্দ্রকুমার দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চান্সেলার স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহে দীনেশ চন্দ্র সেন চন্দ্রকুমার ও অন্যান্য বেতনভোগী কর্মচারীদের সহায়তায় পালা সংগ্রহ করেন।

১৯২৩ খ্রি সংগৃহীত পালাগুলি থেকে ১০টি পালার ইংরেজি অনুবাদ- Estern Bengali Ballads-mymensingha-part–1 ড দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করেন। ১৯২৩ খ্রি কিছুদিন পর ড সেনের সম্পাদনায় ময়মনসিংহ গীতিকা নামে বাংলায় প্রকাশিত হয়। অন্য পালাগুলি পূর্ববঙ্গ গীতিকা (eastern Bengali ballads) নামে ৩টি খন্ডে প্রকাশিত হয়। ময়মনসিংহ গীতিকার ১ম খণ্ডের ১০টি পালার সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে। অন্যান্য সংগ্রাহকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – জসীমুদ্দিন, আশুতোষ চৌধুরী, বিহারীলাল রায় প্রমুখ।

কয়েকটি গীতিকা পালা পরিচিতি

মহুয়া
রচয়িতা দ্বিজ কানাই। যাত্রাপালার ঢঙে রচিত। ২১ টি পরিচ্ছদে বিভক্ত। ট্রাজিক এই পালাটিকে শ্রেষ্ঠ পালা বলা হয়।
উল্লেখযোগ্য চরিত্র – মহুয়া, নদেরচাঁদ, হুমরা বেদে। মহুয়া পালাটির খাঁটি রূপ ১৯১৫খ্রি আবিষ্কার করেন পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ। তিনি ১৯৪৪ খ্রি “বাদ্যানীর গান” নামে প্রকাশ করেন। এতে মহুয়ার নাম দিও মেওয়া,নদের চাঁদ-নদ্যার ঠাকুর।
মলুয়া
কবির নাম অজ্ঞাত। সম্ভবত চন্দ্রাবতীর রচনা। ১৯ অঙ্কে বিভক্ত। উল্লেখ যোগ্য চরিত্র-মলুয়া, চাঁদ বিনোদ।
চন্দ্রাবতী
রচয়িতা নয়ানচাঁদ ঘোষ। ১২ অঙ্কে বিভক্ত। চন্দ্রাবতীর প্রেমের ট্রাজেডিই এই পালায় প্রাধান্য লাভ করেছে। চন্দ্রাবতী ঐতিহাসিক চরিত্র। মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশী দাসের কন্যা। চন্দ্রাবতী বাংলায় রামায়ণের প্রথম মহিলা অনুবাদক হিসাবে পরিচিত। জয়ানন্দ নায়ক চরিত্র।
কঙ্ক ও লীলা
দামোদর, রঘুসুত,নয়নচাঁদ, শ্রীনাথ বেনীয়া এদের সম্মিলিত রচনা।২৩টি অঙ্ক। ঐতিহাসিক সত্যের উপর ভিত্তি করে রচিত।ব্যার্থ প্রেমের কাহিনী। উল্লেখ যোগ্য চরিত্র-কঙ্ক, লীলা, গর্গ। কঙ্ক সত্যপীরের পাঁচালীএবং বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেন। এই পালায় চৈতন্য প্রভাব লক্ষ করা যায়।রামচন্দ্রের উল্লেখ আছে।
কাজলরেখা
রচয়িতা অজ্ঞাত। রূপকথাধর্মী পালা। চরিত্র-কাজল,কুমার,ধনেশ্বর, কঙ্কন দাসী। সমালোচকগন এটিকে গীতিকার পর্যায়ভুক্ত করতে চাননি।
কমলা
রচয়িতার নাম দ্বিজ ঈশান। কমালার সঙ্গে প্রদীপ কুমারের প্রেম বিষয় বস্তু। সরস্বতীর বন্দনা আছে।
দস্যু কেনারামের পালা
চন্দ্রাবতীর রচনা। পালাগুলির মধ্যে এই পালাতেই প্রেমের কোন ভুমিকা নেই। যশোধরা, কেনারাম।
দেওয়ান মদিনা
রচয়িতা জালাল গাইন। এর অপর নাম-আলাল দুলালের পালা।
দেওয়ান ভাবনা
রচয়িতা অজ্ঞাত। দীনেশ চন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর রচনা বলেছেন। নৌকার মাঝিদের মুখ থেকে সংগ্রহ করেন চন্দ্রকুমার দে। করুন রসাত্মক কাহিনী। সুনাই, মাধব,দেওয়ান ভাবনা, চরিত্র।

পালাগুলির বৈশিষ্ট্য

>>নারীচরিত্রের প্রাধান্য, কবিদের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি।
>>জাতী ধর্মের ঊর্ধে প্রেমই শ্রেষ্ঠ এই কথায় কবিরা সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন।
>>চন্দ্রাবতী; নিজে পালা রচনা করেছেন এবং নিজেই আবার পালার চরিত্র।
>>পালাগুলি সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতকে রচিত।

তথ্য সুত্র – বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-তপন কুমার চট্টোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা -ভুদেব চৌধুরী