চৈতন্য জীবনী সাহিত্য – চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে বাংলা ও সংস্কৃতে রচিত হয়েছে নানা গ্রন্থ যা চৈতন্য জীবনী সাহিত্য হিসেবে পরিচিত। আমাদের এই আলোচনায় তেমনি নানা গ্রন্থ নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মূলত শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন ও তত্ত্বদর্শন নিয়ে রচিত গ্রন্থগুলি চৈতন্যজীবনী সাহিত্য বলে পরিচিত।
চৈতন্য জীবনী সাহিত্য – শ্রেণি
সাধারণভাবে জীবনী সাহিত্যকে তিন ভাগে ভাগ করা চলে – জীবনী সাহিত্য (Biography), আত্মজীবনী (Auto-Biography) ও সন্তজীবনী ( Hegiography)। এই তিন শ্রেণির জীবনী সাহিত্য সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১. জীবনী সাহিত্য (Biography) :– যখন অন্য কেউ কারো জীবনকথা লেখেন তখন তা জীবনী সাহিত্য বা Biography রূপে খ্যাত হয়।
২. আত্মজীবনী (Auto-Biography) :– এক্ষেত্রে রচয়িতা নিজেই নিজের জীবন কথা লেখেন।
৩. সন্তজীবনী ( Hegiography) :– যে শ্রেণীর জীবনী সাহিত্যে সাধু,সন্ত এবং ধর্মগুরুদের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ বর্ণিত তাকে সন্তজীবনী বা Hegiography বলে। ‘Hegio’ শব্দের অর্থ ‘সন্ত’। মূলত ধর্মগুরুরা এই বিশেষ জীবনী সাহিত্যের অবলম্বন হয়র থাকেন। সন্তজীবনীতে যুক্তি তর্কের কোন স্থান থাকেনা। চৈতন্যচরিত সাহিত্য গুলি সন্তজীবনী।
সংস্কৃত ভাষায় রচিত চৈতন্য জীবনী কাব্য
শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতম্ বা মুরারি গুপ্তের কড়চা
কাব্যটি মুরারি গুপ্তের রচিত। শ্রীহট্টের অধিবাসী মুরারি চৈতন্যদেবের সঙ্গে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে অধ্যয়ন করতেন। তিনি রামোপাসক ছিলেন। চৈতন্যজীবনী গ্রন্থে তাকে হনুমানের অবতার বলা হয়েছ। প্রথম জীবনে তিনি অদ্বৈতপন্থী ছিলেন। এই গ্রন্থটি চৈতন্য জীবনী সমূহের মধ্যে আদিতম ও আকরগ্রন্থ। কাব্যটি ‘মুরারি গুপ্তের কড়চা’ নামে অধিকতর পরিচিত। দামোদর পণ্ডিতের প্রশ্নের উত্তর দান প্রসঙ্গে মুরারি এই কাব্য রচনা করেন। ‘কড়চা’ বলতে সংক্ষিপ্ত ‘নোট’ বুঝায়, কিন্তু এই কাব্য সংক্ষিপ্ত নয়। এতে চারটি ‘প্রক্রম’ ও মোট ৭৮ টি সর্গ এবং সাড়ে আঠারোশত শ্লোক আছে। বস্তুত বাল্য থেকে তিরোধান পর্যন্ত চৈতন্য-জীবনের প্রায় সবটাই এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কাব্যটি ১৪৩৫ শকাব্দের (১৫১৩ খ্রিঃ) আষাঢ় মাসে শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ হয়েছিল।
পরমানন্দ সেন অথবা ‘কবিকর্ণপুর’
কবি চৈতন্য-পার্ষদ ও পদকর্তা শিবানন্দ সসেনের পুত্র। চৈতন্যদেব কবিকে ‘কবিকর্ণপুর’ (অর্থাৎ কবিদের কর্ণাভরণতুল্য) উপাধি দেন। কবিকর্ণপুরের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যটি ১৪৬৪ শকাব্দের আষাঢ় মাসে ( ১৫৪২ খ্রিঃ) সমাপ্ত হয়। কাব্যটিতে ২০ টি সর্গ এবং ১৯০০ বেশী অধিক শ্লোক আছে। তাঁর ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয়’ নাটকটি কৃষ্ণমিশ্রের রূপকনাট্য ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ এর আদর্শে রচিত হয়। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে ১৫৪০ – ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে নাটকটি রচিত হয়। আর ‘গৌড়গণোদ্দেশদীপিকা’ গ্রন্থে বৈষ্ণব পরিকরের বিবরণ আছে। কাব্যটি ১৫৭৬ খ্রিঃ সমাপ্ত হন। ২১৫ টি শ্লোকে রচিত ক্ষুদ্র কাব্য এটি। অবতারগণ হলেন — কৃষ্ণ > চৈতন্য, বলরাম > নিত্যানন্দ, শিব > অদ্বৈত, যশোদা > শচী দেবী, নন্দ > জগন্নাথ- পুরন্দর, হনুমান > মুরারি গুপ্ত ও বেদ্যব্যাস > বৃন্দাবনদাস
প্রবোধানন্দ সরস্বতী
কাশীবাসী প্রবোধানন্দ সরস্বতী চৈতন্যদেবের পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি চৈতন্য মহিমা অবলম্বনে ‘চৈতন্যচন্দ্রমৃতম্’ নামে একটি স্তবগ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটি ১৪৩ টি শ্লোকে সম্পূর্ণ চৈতন্য-ভক্তি বিষয়ক স্তোত্রকাব্য। কাব্যটি মোট ১২ টি অনুচ্ছেদে সম্পূর্ণ – স্তুতি, নীতি, আশীর্বাদ, গৌরাঙ্গভক্তমহিমা, গৌরাঙ্গ-অভক্ত নিন্দা, দৈন্য, উপাস্যনিষ্ঠা, লোকশিক্ষা, চৈতন্যোৎকর্ষ, অবতার-মহিমা, রূপোল্লাস ও শোচক।
স্বরূপ-দামোদর
স্বরূপ-দামোদরের আদি নাম পুরুষোত্তম আচার্য। তাঁর চৈতন্য জীবনী বিষয়ক গ্রন্থটি হল ‘স্বরূপ-দামোদরের কড়চা’। তবে গ্রন্থটির পাওয়া যায়নি। বৈষ্ণব সমাজে এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। কবি কর্ণপুর তাঁর ‘গৌরগণোদ্দেশদীপিকা’য় বলেছেন, বৈষ্ণব সমাজে সুপরিচিত পঞ্চতত্ত্বের উদ্ভাবয়িতা হচ্ছেন স্বরূপ-দামোদর। এই ‘পঞ্চতত্ত্ব’ বা পাঁচটি প্রধানতত্ত্ব যথাক্রমে ১. চৈতন্য ২. নিত্যানন্দ ৩. অদ্বৈত ৪. গদাধর ৫. শ্রীবাস।
বাংলা ভাষায় রচিত চৈতন্য জীবনী কাব্য
বৃন্দাবন দাস
বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ বাংলা ভাষায় রচিত চৈতন্য জীবনী কাব্য গুলির মধ্যে প্রাচীনতম। বৃন্দাবন দাসের পরিচয় :– অন্যতম চৈতন্য পার্ষদ শ্রীবাস আচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্রী (‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থে শ্রীবাসের এই ভ্রাতার নাম নলিনী পণ্ডিত।) নারায়ণীর পুত্র বৃন্দাবন। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে বৃন্দাবন দাস ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘজীবি বৃন্দাবন দাস ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের পর অনুষ্ঠিত খেতুরি উৎসবেও উপস্থিত ছিলেন। নবদ্বীপের অদূরে মামগাছি গ্রামে বৃন্দাবনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছিল।
‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থ পরিচয়
বৃন্দাবন দাস এই গ্রন্থে চৈতন্য জীবনের প্রধান ঘটনা,বিশেষত আদিপর্বের কাহিনীকে সরস ও স্বচ্ছন্দ গতিতে বর্ণনা করেছেন। এতে তত্ত্বের নিগূঢ় আলোচনা অপেক্ষা চৈতন্য জীবনের কাহিনী ও চৈতন্য ভক্তদের নানা কথা অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে সাধারণ বৈষ্ণব সমাজে এই গ্রন্থের সর্বাধিক প্রচার হয়েছিল। এখনও এ গ্রন্থের গৌরব ও জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন আছে।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ এর ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একখানি সর্বোৎকৃষ্ট গ্রন্থ; পাণ্ডিত্য, মনীষা, ভূয়োদর্শন, মননের গভীরতা, দার্শনিক তত্ত্বনিষ্ঠা ও ঐতিহাসিক তথ্যনুসন্ধিৎসা বিচারে কৃষ্ণদাস অদ্যাপি অদ্বিতীয়। কিন্তু তাঁর গ্রন্থ স্বল্পশিক্ষিত জনের জন্য নয়,উপরন্তু তিনি চৈতন্য জীবন কথা অপেক্ষা চৈতন্য তত্ত্বকথার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন যা সূক্ষ্মবুদ্ধির পণ্ডিতের আদরের সামগ্রী। এইজন্য বৃন্দবনের চৈতন্যভাগবত সাধারন ভক্তসমাজে অধিকতর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাববত প্রথমে ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে পরিচিত ছিল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ এই কাব্যকে ‘চৈতন্যমঙ্গল’ বলেই উল্লেখ করেছেন।
ভাগবতে কৃষ্ণলীলা বর্ণিলা বেদব্যাস।
চৈতন্যমঙ্গলে ব্যাস বৃন্দাবনদাস।।
নিত্যানন্দ দাসের ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থে আছে –
চৈতন্যভাগবতের নাম চৈতন্যমঙ্গল ছিল।
বৃন্দাবনের মহান্তেরা ভাগবত আখ্যা দিল।।
বৃন্দাবন দাস ভাগবতের লীলার অনুসরণে চৈতন্যলীলার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে এ কাব্য চৈতন্যভাগবত নামে কথিত আছে। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে চৈতন্যভাগবত ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়েছিল। বৃন্দাবন দাস তাঁর গুরু নিত্যানন্দ দাসের আদেশে এই কাব্য রচনা করেন। কাব্যটিতে তিনটি খণ্ড আছে – আদি খণ্ড (১৫ টি অধ্যায়), মধ্যখণ্ড (২৬ টি অধ্যায়) ও অন্ত্যখণ্ড (১০ টি অধ্যায়) মোট ৫১ টি অধ্যায়। ছত্র সংখ্যা প্রায় ২৫০০০। কাব্যটি আকস্মিক ভাবে সমাপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়। এই কাব্যে চৈতন্যের অন্ত জীবনের বিস্তারিত বর্ণনা নেই বলে সমালোচকরা মনে করেন। বৃন্দাবন দাস সম্ভবত নিত্যানন্দ,গদাধর ও অদ্বৈতের নিকট চৈতন্যের নবদ্বীপলীলা অবগত হয়েছিলেন। তবে তিনি তাঁর কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন মূলত নিত্যানন্দের মারফত। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত কাব্যে মাত্র দুয়েক স্থলে বিষ্ণুপ্রিয়ার উল্লেখ আছে। এজন্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন –
বাস্তবিক বিষ্ণুপ্রিয়া চৈতন্যভাগবতে ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’।
বৃন্দাবন দাসের ‘বংশবিস্তার’ বা ‘নিত্যানন্দ প্রভুর বংশবিস্তার’ নামে একটি পুঁথির পাওয়া গেছে। নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের চরিত-কথা ও পত্নি জাহ্নবীদেবীর কথাই এর মূল বর্ণনীয় বিষয়।
লোচনদাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’
লোচনদাসকে ত্রিলোচন নামেও অভিহিত করা হয়। তাঁর কাব্যের নাম ‘চৈতন্যমঙ্গল’। বিমানবিহারী মজুমদারের কাব্যটি ১৫৫০-৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত। ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যটি ৪ টি খণ্ডে বিভক্ত– সূত্রখণ্ড, আদিখণ্ড, মধ্যখণ্ড, শেষ খণ্ড। ছত্র সংখ্যা প্রায় ১১০০০। লোচনদাস মুরারি গুপ্তের ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত’ অবলম্বনে চৈতন্যমঙ্গলের কাহিনী সাজিয়েছিলেন। লোচনদাস এই কাব্যে গৌরাঙ্গ ও বিষ্ণুপ্রিয়ার দাম্পত্যজীবনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। লোচনদাস তাঁর এই কাব্যে চৈতন্যদেব সম্বন্ধে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা হল — চৈতন্য দিব্যোভাবে জগন্নাথের শরীরে লীন হয়ে গিয়েছিলেন।
জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’
নগেন্দ্রনাথ বসু সর্বপ্রথম জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলের পরিচয় দেন। এই কাব্যটি নগেন্দ্রনাথ বসু ও কালিদাস নাথের সম্পাদনায় ১৩১২ বঙ্গাব্দে সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। জয়ানন্দের জন্ম বর্ধমানের আমাইপুরা গ্রামে। পিতা-সুবুদ্ধি মিশ্র, মাতা -রোদনী। শৈশবে জয়ানন্দের নাম ছিল গুইয়া। চৈতন্যদেব এই কুৎসিত নাম বদলে জয়ানন্দ নামকরণ করেন। কাব্যটির রচনাকাল ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ। কাব্যটি ৯ টি খণ্ডে বিভক্ত — আদি খণ্ড, নদীয়া খণ্ড, বৈরাগ্য খণ্ড, সন্ন্যাস খণ্ড, উৎকল খণ্ড, প্রকাশ খণ্ড, তীর্থ খণ্ড, বিজয় খণ্ড, উত্তর খণ্ড। জয়ানন্দ তাঁর কাব্যে চৈতন্যের পূর্বপুরুষকে উড়িষ্যার জাজপুরের অধিবাসী বলছেন। জয়ানন্দের কাব্যে চৈতন্য-তিরোধানের লৌকিক কাব্যের বর্ণনা আছে– রথের দিন ভাবাবেশে নৃত্য করতে গিয়ে পায়ে ইটের টুকরো বিদ্ধ হন এবং তার থেকেই চৈতন্যদেব পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যান।
কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ও অন্যান্য
কৃষ্ণদাস কবিরাজ বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকট ঝামটপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতা-ভগীরথ, মাতা-সুনন্দা। কবি আজীবন অকৃতদার ছিলেন। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে কবির জন্ম হয়। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে কাব্যটি ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দের এই কাব্য রচনা শুরু হয় এবং ১৬১২-১৫ খ্রিস্টাব্দে লেখা সমাপ্ত হয়। অসিতকুমার বন্দ্যেপাধ্যায়ের মতে কাব্যটি ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দের পর রচিত হতে আরম্ভ হয়।
বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ একে অপরের পরিপূরক গ্রন্থ। বৃন্দাবন দাস চৈতন্য-জীবনের যে স্থান ছেড়ে গেছেন সেই স্থলে কৃষ্ণদাস জোর দিয়েছেন। চৈতন্যভাগবতে চৈতন্যের জীবনের অন্তপর্ব সেই ভাবে আলোচিত না হওযায় কৃষ্ণদাস চৈতন্যচরিতামৃত কাব্যে তা যথাযথ ভাবে তুলে ধরেছেন। কৃষ্ণদাস স্বরূপ-দামোদর ও মুরারি গুপ্তের গ্রন্থে বর্ণিত লীলাসূত্র অনুসরন করেছেন। কৃষ্ণদাস বিবৃতিমূলক জীবনী রচনার প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি চৈতন্য-জীবনের তাৎপর্য,গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের মূল তত্ত্ব, চৈতন্য-শাখা নির্ণয় এবং মহাপ্রভুর অন্তলীলা সম্বন্ধেই অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। কাব্যটি ৩ টি অংশে বিভক্ত — আদিলীলা (১৭ টি পরিচ্ছেদ), মধ্যলীলা (২৫ টি পরিচ্ছেদ), অন্ত্যলীলা (২০ টি অধ্যায়)।
কৃষ্ণদাস কবিরাজের অন্যান্য গ্রন্থ
১. ‘গোবিন্দলীলামৃত’– সংস্কৃত ভাষায় লেখা ২৩ সর্গে, ২৪৮৮ টি শ্লোকে সমাপ্ত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা সংক্রান্ত কাব্য।
২. ‘সারঙ্গ-রঙ্গদা’– এটি লীলাশুকের ‘ ‘শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত’ এর টীকা।
রঘুনাথ দাস ‘মুক্তাচরিত’ গ্রন্থে কৃষ্ণদাসকে ‘কবিভূপতি’ বলে বিশেষ প্রশংসা করেছেন।
গোবিন্দদাসের কড়চা
কবির নাম গোবিন্দদাস কর্মকার। ‘গোবিন্দদাসের কড়চা’ ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে শান্তিপুর নিবাসী স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের হেডপণ্ডিত অদ্বৈতবংশীয় জয়গোপাল গোস্বামী কর্তৃক প্রকাশিত হয়। তবে গ্রন্থটির প্রামানিকতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে — এ বিষয়ে অসিতকুমার বন্দ্যেপাধ্যায়ের মত –
তদুপরি বর্ণনা, শব্দ যোজনা ও আদর্শে এমন আধুনিকতার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে যে গোবিন্দদাসের কড়চাকে চৈতন্যদেবের প্রাচীন,প্রামাণিক ও বিশুদ্ধ জীবনী বলে কিছুতেই গণ্য করা যায় না।
চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গবিজয়
কাব্যটি ‘ভুবনমঙ্গল’ নামেও পরিচিত। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে সুকুমার সেন এর সম্পাদনায় এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গবিজয় কাব্যটি প্রকাশিত হয়। এই কাব্যের অনেক স্থলে ব্রজবুলি ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর জীবনী-গ্রন্থ
প্রেমদাস :– এর আসল নাম পুরুষোত্তম মিশ্র। চৈতন্যদেবের জীবনী বিষয়ক এর দুটি গ্রন্থ পাওয়া যায় ১. ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয় কৌমুদী’– এই গ্রন্থটি (আখ্যান কাব্য) কবিকর্ণপুরের ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয়’ শীর্ষক চৈতন্য-জীবন বিষয়ক সংস্কৃত রূপক নাটকের স্বচ্ছন্দ অনুবাদ। ২. ‘বংশীশিক্ষা’– এই গ্রন্থে চৈতন্যতত্ত্ব ও চৈতন্য জীবন-কথা আংশিকভাবে আলোচিত হয়েছে। অকিঞ্চন দাসের ‘বিবর্তবিলাস’ ৫ অঙ্কে বিভক্ত, এই কাব্যে বৈষ্ণব সমাজ, ব্যক্তি ও সম্প্রদায় সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য আছে।ভগীরথের ‘চৈতন্য-সংহিতা’, হৃদানন্দের ‘চৈতন্যলীলা’, রামরত্নের ‘শ্রীচৈতন্যরত্নাবলী’, পুরন্দরের ‘চৈতন্যচরিত’, দ্বিজ নিত্যানন্দের ‘শ্রীচৈতন্য পাঁচালী’, এবং কৃষ্ণচরণ দাসের ‘শ্যামানন্দপ্রকাশ’ (শ্যামানন্দের জীবনকথা বর্ণিত)।
অন্যান্য জীবনী গ্রন্থ
অদ্বৈত আচার্যের জীবনী গ্রন্থ – লাউড়িয়া কৃষ্ণদাসের সংস্কৃতে রচিত ‘বাল্যলীলাসূত্র’, ঈশাননাগরের ‘অদ্বৈতপ্রকাশ’, হরিচরণ দাসের ‘অদ্বৈতমঙ্গল’, নরহরি দাসের ‘অদ্বৈতবিলাস’। এছাড়াও অদ্বৈত-গৃহিনী সীতাদেবীর জীবনী গ্রন্থও রচিত হয়েছে। যেমন – লোকনাথ দাসের ‘সীতা চরিত্র’, বিষ্ণুদাস আচার্যের ‘সীতাগুণকদম্ব’।