চৈতন্যজীবনী সাহিত্য
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চৈতন্যজীবনী সাহিত্য এক অন্যতম অধ্যায়। জীবনীসাহিত্য রচনার সূত্রপাত ঘটে ষোড়শ শতকে চৈতন্য দেবের জীবনকে কেন্দ্র করে। জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর সন্তান বিশ্বম্ভর তথা নিমাই তথা চৈতন্যদেব ১৪০৭ শকাব্দের (১৪৮৬ খ্রি:২৭ শে ফেব্রুয়ারি),৮৯২ বঙ্গাব্দে, ২৩ফাল্গুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবন পরবর্তীতে দর্শনে পরিণত হয়। তিনি হয়ে ওঠেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
দেখে নেওয়া যাক চৈতন্যদেবের জীবনী সংক্রান্ত কোন কোন গ্রন্থ আছে ?
ক) সংস্কৃত জীবনী
প্রথম চৈতন্যজীবনী সাহিত্য রচিত হয় সংস্কৃতে। তখন চৈতন্য মহাপ্রভু জীবিত ছিলেন। প্রথমে চৈতন্য জীবন মূলত স্তব ও স্তোত্র, পদের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। নরহরি সরকার, রঘুনাথ দাস কিছু রচনা করেন। চৈতন্য জীবনী সমূহের মধ্যে আদিমতম” মুরারি গুপ্তের কড়চা “/ “শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতম্”। শ্রীহট্টের অধিবাসি মুরারি চৈতন্য দেবের সঙ্গে গঙ্গাদাস পন্ডিতের টোলে অধ্যয়ন করতেন।
“শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতম্” মুরারি গুপ্তের “কড়চা” নামে অধিকতর পরিচিত। এতে মোট ৪ টি প্রক্রম এবং ৭৮টি সর্গ আছে। মুরারির এই কাব্যে চৈতন্যের “জন্ম থেকে তিরোধান অবধি বর্নণা আছে।”
কবিকর্ণপুর পরমানন্দ সেন :- কবি ও নাট্যকার রুপে তিনি মধ্যযুগের সংস্কৃত সাহিত্যে সুপরিচিত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ গুলি হল :- ক) চৈতন্যচরিতামৃত কাব্য খ) চৈতন্যচন্দ্রদয় নাটক গ) গৌরগণোদ্দেশদীপিকা
প্রভৃতি। কবিকর্ণপুরের চৈতন্যচরিতামৃত কাব্যটি ২০ টি সর্গে বিভক্ত। চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকে চৈতন্য জীবনের সমগ্র ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
প্রবোধানন্দ সরস্বতী :- তিনি চৈতন্য দেবের পরম ভক্ত ছিলেন এবং চৈতন্য মহিমা অবলম্বনে চৈতন্যচন্দ্রামৃত” নাটক রচনা করেন।
স্বরুপ দামোদর এর “কড়চা” কথা জানা যায়।
খ) বাংলা চৈতন্যজীবনী সাহিত্য
বৃন্দাবন দাস (চৈতন্যভাগবত) ঃ বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত বাংলায় রচিত প্রথম চৈতন্য জীবনী গ্রন্থ। তাঁর গ্রন্থ “চৈতন্যমঙ্গল” নামেও পরিচিত ছিল। সমগ্র কাব্যটি ৩টি খন্ডে বিভক্ত। আদি খণ্ড-(১৫ টি পরিচ্ছেদ)
মধ্যখণ্ড-(২৬ টি পরিচ্ছেদ) ও অন্ত্যখণ্ড-(১০ টি পরিচ্ছেদ)। আদি খন্ডে জন্ম থেকে গয়াগমন। মধ্য খন্ডে গয়াপ্রত্যাবর্তন থেকে সন্ন্যাসগ্রহন। অন্ত্য খণ্ডে সন্ন্যাস থেকে তিরোধান। মুলত চৈতন্যের অলৌকিক কাহিনি এতে বলা হয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া এই কাব্যে উপেক্ষিতা।
লোচন দাস (চৈতন্যমঙ্গল) :- এই কাব্যের চারটি খন্ড। সূত্রখণ্ড– এখানে স্বর্গের কাহিনি ও চৈতন্যবতারের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আদিখণ্ড – জন্ম থেকে বয়ঃপ্রাপ্তি,গয়াগমন থেকে প্রত্যাবর্তন। মধ্যখণ্ড – নদিয়া লীলা ও উৎকল লীলা স্থান পেয়েছে। অন্ত্যখণ্ড – দক্ষিন যাত্রা, রামানন্দের সঙ্গে মিলন, পুরী প্রত্যাবর্তন,নীলাচলে অবস্থান, তিরোধান স্থান পেয়েছে। গৌরনাগর ভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। গৌরাঙ্গ ও বিষ্ণুপ্রিয়ার দাম্পত্য জীবনের বর্ণনা আছে।
জয়ানন্দ (চৈতন্যমঙ্গল)ঃ এই গ্রন্থটি ৯টি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ড- আদি খন্ড – যুগধর্মকর্ম দ্বিতীয় খণ্ড-নদীয়া খণ্ড – গৌরাঙ্গের জন্ম তৃতীয় খণ্ড – বৈরাগ্য খণ্ড – গৃহত্যাগ চতুর্থ খণ্ড – সন্ন্যাস – প্রভুর সন্ন্যাস গ্রহন
পঞ্চম খণ্ড – উৎকল খন্ড -নীলাচল ষষ্ঠ খণ্ড -প্রকাশ খণ্ড- প্রকাশ উজ্জ্বল সপ্তম- খন্ড – তীর্থ খন্ড- তীর্থের বর্ণনা অষ্টম খণ্ড -বিজয় খণ্ড – বৈকুন্ঠ পুর নবম খণ্ড – উত্তর খণ্ড। কাব্যে বিষ্ণুপ্রিয়ার বারমাস্যার বর্ণনা আছে।
আরো তথ্য
কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত) ঃ আদি লীলা :-মোট ১৭ টি পরিচ্ছেদ। বাল্য থেকে ২৩ বছরের জীবন এতে বর্ণিত। ১ম থেকে ১২ তম পরিচ্ছেদে বৈষ্ণব তত্ত্বদর্শন, চৈতন্যবতারের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা আছে। ১৩ তম থেকে ১৭ অবধি বাল্যলীলা ও কৈশোর কাহিনি। মধ্য লীলায় ২৫ টি পরিচ্ছেদ। এখানে কৃষ্ণদাস গৌড়ীয় ভক্তিবাদ, রাগানুগা ভক্তি আদর্শ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।৮ পরিচ্ছেদে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের রসতত্ত্ব ও রসপর্যায়ের কথা আছে। অন্ত্য লীলা ২০ টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। চৈতন্যের শেষ ১২ বছরের দিব্যোন্মাদ অবস্থার কথা জানা যায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বের সূচনা ঘটে এই কাব্যকে কেন্দ্র করে।
গোবিন্দদাসের কড়চাঃ এটি চৈতন্যদেবের দাক্ষিণাত্য ও পশ্চিম ভারত ভ্রমণ বিষয়ক পয়ার ছন্দে রচিত কাব্য। তবে এই কাব্য নিয়ে পন্ডিত মহলে নানা মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।
চূড়ামণি দাসের কাব্যের নাম গৌরাঙ্গবিজয়। এই গ্রন্থটি” ভুবনমঙ্গল” নামেও পরিচিত। এর একটি মাত্র খণ্ডিত পুথিঁ পাওয়া গেছে।
চৈতন্যজীবনী সাহিত্য যার সূচনা ঘটেছিল মধ্যযুগে তা ক্রমে ক্রমে আধুনিক যুগেও সমান ভাবে আলোচিত। চৈতন্য জীবন ও দর্শন আজকের দিনেও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।