ভারতীয় গণনাট্য সংঘ
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ হল বামপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বে পরিচালিত থিয়েটার-শিল্পীদের সংগঠন। টির লক্ষ্য ছিল ভারতের জনসাধারণের মধ্যে বামপন্থী মতাদর্শ প্রচার এবং তাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষে এক অস্থির অবস্থার সূচনা ঘটে । সমগ্র ইউরোপে এই যুদ্ধের দামামা বাজলে পরাধীন ভারতবর্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্গতি চরমে পৌছায়।মানুষের দৈনন্দিন জীবন শুধু নয়, সাহিত্য সংস্কৃতির জগতেও ঘটে পরিবর্তন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্তর্গত, নাট্যসাহিত্যের ধারাতেও আসে পরিবর্তন, আর পৌরাণিক নাটক নয়, সমাজের উচ্চবৃত্ত মানুষের মনোরঞ্জন নয়, নাটক হয়ে ওঠে একেবারে কঠিন বাস্তবের এক মূর্ত প্রতীক।
ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি তাদের নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে নিয়ে আসে জনমুখী ও সংগ্রামী চেতনাকে। সাম্যবাদকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় Youth Cultural Institute. মনে করা হয় এখান থেকেই শুরু হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ এর পথচলা। ঠিক সেই সময় প্রগতিবাদী লেখক সোমেন চন্দ প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন ঢাকায়। এর ঠিক পরেই ২৮ শেমার্চ ১৯৪২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় “ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ ” এর।এই ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের নাট্যবিভাগ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় “ভারতীয় গণনাট্য সংঘ” ( Indian People’s Theatre Association)এর।
মানুষের নিত্যদিনের দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনা এবং সেই সেই শোষণ বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষের যে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ যে গণজাগরণ তাই হল গণনাট্য।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ এর স্থাপনার পিছনে বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক রঁমা রোঁলার The People’s Theatre এবং চীন ও স্পেনের নাট্য আন্দোলনের আদর্শ কাজ করেছে। জনগণই হয়ে উঠল গণনাট্যের একমাত্র নায়ক। গণনাট্যের ধারক ও বাহকেরা সাম্যবাদে নিজেদের নিয়োজিত করেন। গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠা এবং ছোটো ছোটো নাটক অভিনয়ের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন দিকের কুৎসিত রুপ সকলের সামনে দেখা দিল। কালোবাজারি, স্বার্থান্বেষী মানুষ এর রুপ, তাদের অত্যাচারের নির্মম কাহিনি রুপ পেল নাটকের কাহিনির মধ্যে। গণনাট্য হয়ে উঠল এক পথ প্রদর্শক। জনসাধারণ কে নিয়ে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে যে সচেতনতা দেখা দিল তা অল্পকালেই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গণনাট্য এবং রাজনীতি যে একজায়গায় মিশে আছে তা বোঝাতে গিয়ে বিজন ভট্টাচার্য তাঁর “গণনাট্য আন্দোলনের সেকাল ও একাল ” প্রবন্ধে বলেছেন, “গণনাট্য সংঘের কথা বলতে গিয়ে রাজনীতির কথা স্বতঃই এসে পড়ে, কেন না রাজনীতি বিবর্জিত শিল্পকর্মের কথা, কী সঙ্গীতে, কী নাট্যচিন্তায়, ভাবনায়, অন্তত গণনাট্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা যায় না।” ( শারদীয় কালান্তর, ১৩৭৪ ব:)
গণনাট্য ছিল একটি যৌথ প্রযোজনা, এখানে কোনো শক্তিধর শিল্পীর প্রতিভাকে অশ্রদ্ধা করা হয়না ঠিক তেমনই যৌথ ভূমিকাকেও অস্বীকার করা হয় না। গণনাট্যের দর্শক ছিলেন সমাজের একেবারে সাধারণ মানুষ, যাদের কাছে দিন আনা দিন খাই ই মুখ্য। এর মধ্য দিয়ে গণনাট্য চেতনার উন্মেষ ঘটানোর চেষ্টা করে। জীবনের বাস্তব সমস্যা কে তুলে ধরে সেই সমস্যা থেকে মুক্তির পথ বলে দেয় গণনাট্য। মঞ্চসজ্জার ক্ষেত্রেও গণনাট্য স্বতন্ত্রতা নিয়ে আসে, দর্শকদের সুবিধার্থে অভিনয় স্থল উচুঁ করা হয়। এর পরিচালনা ছিল খুবই সাধারণ কিন্তু এর বার্তা ছিল বেশ স্পষ্ট। গণনাট্য, গণসংযোগের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে সহায়তা করে।
গণনাট্যের এই রুপকে সামনে রেখে ১৯৪৪, ২৪ শে অক্টোবর “শ্রীরঙ্গম”এ অভিনিত হয় বিজন ভট্টাচার্যের বিখ্যাত নাটক “নবান্ন” । এছাড়া ও তাঁর লেখা “আগুন”, “জবানবন্দী ” প্রভৃতি নাটক গণনাট্যের পরিচালনায় প্রযোজিত হয়। ভারতের স্বাধীনতা পর্বের আগে অবধি গণনাট্য তার আদর্শ কে সামনে রেখে এক রুচিশীল চেতনাসম্পন্ন সচেতন সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
আলোচক – সুকান্ত চ্যাট্টার্জী, বাংলা ছাত্র, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।