নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য
বিংশ শতাব্দীর নাট্যকারদের মধ্যে বিজন ভট্টাচার্য এক স্মরণীয় নাম। বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় ১৭ ই জুলাই, ১৯১৭খ্রি: তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন ১৯৩০ খ্রি:।
রেবতি বর্মনের লেখা মার্কসীয় দর্শন পড়ে সাম্যবাদে দীক্ষিত হন। কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ গ্রহণ করেন ১৯৪২ এ। মৃত্যু ১৯৭৮ খ্রি:। নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ভাবে আলোচনায় চলে আসে “গণনাট্য “বা ” “নবনাট্য” এর।
গণনাট্য বা নবনাট্যের উন্মেষ ঘটেছিল দেশের স্তিমিতপ্রায় সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তুলতে এবং তাকে প্রাণবন্ত করে জনগনের মধ্যে তাকে নিয়ে আসার এক প্রচেষ্টার মাধ্যমে। গণসংযোগের মধ্য দিয়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলাই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য।
ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের অঙ্গ হিসাবে ১৯৪২ এ জন্ম হয় – গণনাট্য সংঘের। ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি হয়ে ওঠে এর পথ প্রদর্শক। এই গণনাট্যের মঞ্চেই আত্মপ্রকাশ ঘটে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের।
বিজন ভট্টাচার্য প্রায় ২৫ টির ও বেশি নাটক রচনা করেন। তাঁর নাটক গুলি হল –
পূর্ণাঙ্গ নাটক নবান্ন (১৯৪৪) অবরোধ (১৯৪৭) জতুগৃহ (১৯৬২) গোত্রান্তর (১৯৫৯) মরাচাঁদ (১৯৬২) ছায়াপথ (১৯৬২) মাষ্টারমশাই (১৯৬১) দেবীগর্জন (১৯৬৯) কৃষ্ণপক্ষ (১৯৬৬) ধর্মগোলা (১৯৬৭) আজ বসন্ত(১৮৭০) গর্ভবতী জননী (১৯৬৯) সোনার বাংলা (১৯৭১) চলোসাগরে (১৯৭২) প্রভৃতি।
একাঙ্ক নাটক জবানবন্দী (১৯৪৩) আগুন (১৯৪৩) কলঙ্ক (১৮৫০) জননেতা (১৯৫০) সাগ্নিক (১৯৬৮) চুল্লি (১৯৭৪) হাঁসখালির হাঁস (১৯৭৭)
রুপক নাটক স্বর্ণকুম্ভ (১৯৭০)
গীতিনাট্য জীয়নকন্যা (১৯৪৮)
নাট্য রুপায়ণ গুপ্তধন (১৯৭২) নীলদর্পণ (১৯৭২)
বিজন ভট্টাচার্যের নাটক পরিচিতিঃ
বিজন ভট্টাচার্য একজন সাম্যবাদী নাট্যকার। আধুনিক নবনাট্যের জন্মদাতা তিনি। বিজন ভট্টাচার্যের লেখা প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ট নাটক ‘নবান্ন’ (১৯৪৪)। নাটকটির ৪টি অঙ্ক। ১ম ও ৪ র্থ অঙ্কের ঘটনা মেদিনীপুরের আমিনপুর গ্রামের ২য় ও ৩ য় অঙ্ক কলকাতার ছবি। ‘নবান্নে’র প্রথম প্রকাশ ঘটে “অরণি” পত্রিকায়। ‘নবান্নে’র হিন্দি সংস্করন ঘটে ১৯৪৭ এ।
‘অবরোধ’ নাটকটি প্রেক্ষাপট – শ্রমিক জীবনের দুর্দশার চিত্র। নাটকটির ৬ টি অঙ্ক।
‘গোত্রান্তর’ নাটকের প্রকাশ ১৯৫৭ সালে ‘শারদীয়া বসুমতি’ তে।
‘ছায়াপথ’ – নাটক কৃষক জীবনের যন্ত্রনার ছবি।
‘জতুগৃহ’ নাটকটি পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
‘মরাচাঁদ’ – এটি সঙ্গীত শিল্পীদের যন্ত্রনার আখ্যান।এটি প্রথম একাঙ্ক ভাবে রচিত হলেও পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ নাটকে পরিণত হয়।
‘দেবীগর্জন’ – বিজন ভট্টাচার্যের লেখা একটি অন্যতম নাটক।বীরভূমের সাঁওতাল কৃষকদের আন্দোলন এতে স্থান পেয়েছে।
‘কৃষ্ণপক্ষ’ প্রকাশিত হয় শারদীয়া থিয়েটার পত্রিকায়।
‘আজ বসন্ত’ প্রকাশিত হয় শারদীয়া গল্পভারতীতে।
‘সোনার বাংলা’ – বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা।
‘গর্ভবতী জননী’ – বেদেদের জীবন কাহিনি নিয়ে লেখা।
‘চলোসাগরে’ পরিচয় ‘পত্রিকায়’ প্রকাশিত হয়।
‘আগুন’ প্রকাশিত হয় “অরণি” পত্রিকায়। ৫টি দৃশ্যে নাটকটি বিভক্ত।
‘জবানবন্দী’ নাটকটি “অরণি” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
গণনাট্য ও নবান্ন নাটক
ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের অঙ্গ হিসাবে গণনাট্যের আবির্ভাব ঘটে।গণনাট্য আন্দোলনের এক যথার্থ ফসল হয়ে ওঠে নবান্ন নাটক। যুদ্ধ, মন্বন্তর, মড়ক, কালোবাজারি,অনাহার,মৃত্যু বাঙালির জীবনে বয়ে আনা সব ভয়ংকর সমস্যা এই নাটকে বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। ১৯৪৪ এ “নবান্ন “নাটক মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতি শুরু করা হয়। অবশেষে ওই বছরই অক্টোবরে ‘শ্রীরঙ্গম’ এ ‘নবান্ন’ মঞ্চস্থ করা হয়। যার সম্পাদক ছিলেন চিত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যগুরু ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য।
বিজন ভট্টাচার্য একই সঙ্গে গণনাট্য ও নবনাট্যের পুরোধা ব্যক্তি। সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে সাধারণ নাট্যশালার বাইরে এসে অদম্য উৎসাহী একদল যুবকের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে এক নবনাট্য আন্দোলন।যার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন ঘটে প্রচলিত নাট্যশালার। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন যার মধ্যে অন্যতম।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য তাই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
লেখক – সুকান্ত চ্যাট্টার্জী