অন্যান্য মঙ্গলকাব্য

শিবায়ন – শিবমঙ্গল কাহিনী

শিবায়ন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ মঙ্গলকাব্য ধারা । হিন্দু দেবতা শিবকে কেন্দ্র করে রচিত এই কাব্যগুলি। কিন্তু কেবল আধ্যাত্মিকতাই নয়, এই কাব্যগুলিতে ফুটে উঠেছে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের কথা।

শিবমঙ্গলের উৎস কথা

শিবায়ন -এর উৎস কথায় জানা যায়, ব্রাহ্মণ্যধর্ম ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অনেক উপাদান লৌকিক শৈব ধর্মের সাথে একীকরণ হয়ে যায়। তারপর দিন এগিয়েছে কালাক্রমে অজস্ব ছড়া ও আখ্যান সৃষ্টি হয়েছে । শিবের গাজনে সেই শিব সম্পর্কিত ছড়া আবৃত্তি হয়েছে । আর এর পরই বিবিধ শিবের মন্দির স্থাপনের পালা । প্রচার পেয়েছে শিবমঙ্গল কাহিনী  বৃন্দবন দাসের “চৈতন্যভাগবত” গ্রন্থে লিখেছেন –
“একদিন আসি এক শিবের গায়ন,
ডমরু বাজায় গায় শিবের কথন ।।
আইল করিতে ভিক্ষা প্রচুর মন্দিরে ।
গাইয়া শিবের গীত বেরি নৃত্য করে ।।

আবার রবি কবির ভাষায় “আমাদের পুরাণে শিবের মধ্যে ঈশ্বরের দরিদ্র বেশ, আর অন্নপূর্ণায় তাঁর ঐশ্বর্য। বিশ্বে এই দুই” এর মিলনেই সত্য।“ভারতীয় সভ্যতায় শিল্প সাহিত্য ধর্ম কর্ম জীবনে শিব এক অখণ্ড সত্য হিসাবে সবসময় বিবেচিত ।
তাই বিবেকানন্দ বলেছেন ‘ভুলিও না তোমার উপাস্য দেবতা সর্বত্যাগী শংকর “। ষোড়শ শতকে শিবের গীত মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত, এমনকি নাথ যোগীরাও শিবকে নিজেদের গুরু হিসাবে মান্য করতেন । বিদ্যাপতির শিবগীতিতে লৌকিক শিবের আখ্যান প্রচারিত হয়েছে ।
“বেরি বেরি আর শিবসংস্কৃতমোঞে তোকে বোলঞে
কিরিষি করিয় মন নাই ।
বিনু সমরে হয়সংস্কৃতভিখিএ পত্র মাগিয়
গুণ গৌরব দূর জাই ।“

শিবের গীত

গাজন উৎসবে শিবের গীত গাওয়া হয়ে থাকে –
“শিব চইলাছেন বিয়ার বেশে নারদ বাজায় বীনা ।
পাড়া পড়শী দেখতে এল বিয়ার কথা শুইনা ।।“
মঙ্গলকাব্য ধারায় “শিবায়ন “ কাব্যের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান । মঙ্গল কাব্যের দেব দেবীরা যে নিজ মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তা শিবায়নে অনুপস্থিত । শিব এখানে লৌকিক দেবতা । শিব চরিত্রে পৌরাণিক মাহাত্ম্য নেই বললেই চলে ।
সেখানে “মনসামঙ্গল “ ও “চণ্ডীমঙ্গল “ এর দেবখণ্ড বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতিতে শিবের প্রভাব

শিবায়ন কাব্য আলোচনার পূর্বে আমরা ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতিতে শিবের প্রভাব সম্পর্কে পাই , ভারতীয় জীবনের ধর্ম কর্ম , পারিবারিক কল্যাণ , নর নারীর বৈবাহিক সম্পর্কে ও পূজাপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়ে শিব দেবতার প্রভাব অপরিসীম ।
ভারতীয় জীবনের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ এবং জগৎ ও জীবনের আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার একান্ত মূলে শিব । সামাজিক জীবনের নিত্য সহচর তিনি ।, এক কথায় একই অঙ্গে বিচিত্র রূপের বাহার । তিনি ধ্বংস সাধনে ভয়ঙ্কর আবার বিচিত্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধীশ্বর । তিনি আশুতোষ , আত্মভোলা , সদা হাস্যময় । ঋগ্বেদের দেবতা রুদ্র পৌরাণিক যুদে শিবে পরিণত হয়েছে । পণ্ডিতদের মতে ভারতীয় শৈবধর্মের অষ্ট্রিক অর্থাৎ দ্রাবিড় ও কোলগোষ্ঠির ভাবনাচিন্তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।
এককথায় শিব ভারতীয়দের মনঃপ্রকৃতি ও জীবনাদর্শের প্রতীক ।

প্রথম শিবায়ন কাব্য

সতেরো শতকে “মৃগলুব্ধ “নামে প্রথম “শিবায়ন” কাব্য রচিত হয় । দ্বিজরতিদেব ও শিশুরাম রায় এই আখ্যানের জন্য খ্যাত । শিব চতুর্দশীর আখ্যানই এখানে গুরুত্ব পেয়েছে । শিবায়ন কাব্য রচনা করে বিখ্যাত হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ রায়।
রামেশ্বরের শিবায়ন আটটি পালায় বিভক্ত । পূর্বে শিব, কৃষি ও সৃষ্টির দেবতা  লোক জীবনের এই শিবের জন্মান্তর ঘটেছে ।  বৃদ্ধ পতি তিনি , ভিক্ষা করে সংসার চালান , আবার রাঢ় অঞ্চলের লোক গীতিতে “শিবের চাষ “ উল্লেখ করে বলা হয়েছে ,

“দূর্গা বলে –
শিবের ঘরে অন্ন নাই বাতাসে নড়ে হাঁড়ি
সকলেরে ধন দিয়া আপনি ভিখারী ।।
কাল ভিক্ষা করে এলাম কুজানি নগরে ।
উঠে মুঠে বলছে দুর্গা , অন্ন নাহিক ঘরে ।।
আবার কোচ নারীর সাথে শিবের সম্পর্ক তুলে ধরা হ্যেছে
“ভাঙ খাইবে ধুতরা খাইবে শতাবরি ।
দিবারাত্রি থাকবে তুইন কুচনারীর বাড়ী “
শিবের রূপান্তরের নিরিখে নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন –
“শ্মশান আন্তর পর্বতের রিক্ত দেবতা একান্তই দ্রাবিড় ভাষীদের শিবন্‌ । যাএ লাল বা রক্ত এবং শেম্বু যাহার অর্থ তাম্র , ইনিই ক্রমে ক্রমে রূপান্তরিত হইয়া আর্য দেবতা রূদ্রের সঙ্গে এক হইয়া যান । পরে শিবন –শিব , শেম্বু = শম্ভু , রুদ্র = শিব এবং মহাদেব রূপান্তর লাভ করেন “।

শিবমঙ্গল কাহিনী

শিবমঙ্গল কাহিনী থেকে জানা যায়, দেবতাদের সভায় শিব তাঁর শ্বশুর প্রজাপতিকে সম্মান না দেখানোয়, এক অপমানের প্রতিশোধ পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষ যজ্ঞের আয়োজন । সেই যজ্ঞে শিব নিমন্ত্রিত নন, সতী বিনা নিমন্ত্রণে উপস্থিত । আর প্রজাপতি সতীর সম্মুখে শিবের নিন্দা করতে থাকেন । স্বামী নিন্দা শোনা মাত্র সতীর প্রাণত্যাগ । সতীর দেহত্যাগের খবর শোনামাত্র শিব ভূত প্রেত দানব দৈত এনে যজ্ঞ লণ্ড ভণ্ড করেন । এরপর পুনরায় মেনকার কোলে সতী আসেন গৌরী হয়ে । ভিখারী শবের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। শিব তখন শ্মশানে ঘুরে বেড়ান, রোজকার করেন না । অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গৌরী শিবকে চাষ করতে বলেন । কিন্তু অলস শিব , তবুও একপ্রকার গৌরীর অনুরোধে ইন্দ্রের কাছ থেকে জমি গ্রহণ। শিবের ত্রিশূল ভেঙ্গে বিশ্বকর্মার লাঙ্গল, জোয়াল, মই গড়ে দেন । কুবের শিব কয়ে বীজ ধান ধার দিলেন । শেষ মাঘে ভীমের সাহায্যে শিবের জমি চাষ । ফলন প্রচুর আর ফলস্বরূপ শিব চাষের নাশায় আর স্বর্গে ফিরতে চান না ।

তারপর ?

শেষে সকল চেষ্টা ব্যার্থ হলে গৌরী বাগ,দিনী সেজে শিবের কাছে হাজির হন। বাগদিনী মাছ ধরে শিবের ক্ষেতে আর সেই বাগদিনীর রূপে মুগ্ধ হয়ে শিব তাকে বিবাহ করার প্রস্থাব দেন । সেই সময় তিনি শিবের কাছে পিতলের একটি আংটি চাইলেন । ছল করে পুনরায় গৌরী শিবকে স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন । স্বর্গে ফিরে এসে গৌরী নিজ রূপ ধরলেন কিন্তু তিনি শিবকে আর ফিরিয়ে নিতে রাজী নন । কারণ শিব বাগদিনীর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং অঙ্গুরী উপহার দেন । নারাদের সম্মুখে পার্বতী তাঁর স্বামীর ব্যাভিচারের কথা বললে নারন পার্বতীকে এক জোড়া শাঁখা চেয়ে তাঁকে বশে রাখতে বললেন । শিব বললেন তাঁর পক্ষে শাঁখা দেওয়া অসম্ভব কারণ শিব ভিক্ষুক ।

ক্রমে কোন্দল বিশাল আকার ধারণ করে । পার্বতী পিতৃগৃহেচলে গেলেন , সেখানে তখন দূর্গোৎসব । শেষে আবার নারদের কথা মত শিব শাঁখারী বেশে হিমালয়ের গৃহে এলেন । পার্বতী শিবকে শাঁখার দাম জিজ্ঞাসা করলে পার্বতী আত্মসমর্পণ করলেন । পার্বতী শিবকে চিনতে পারলেন এবং দশহাত বাড়িয়ে দিলেন । শিবের হাতে শাঁখা পড়ে পার্বতীর রাগ ভাঙল এবং উভয়ে কোইলাসে ফিরে এলেন ।

শিবায়ন কাব্যের বৈশিষ্ট্য

পৌরাণিক শিব অপেক্ষা গ্রাম্য শিবের চরিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে ।
শিবায়ন কাব্য শিবকে কাব্যিক সন্ধানে পাওয়া যায় ।
শিব চরিত্রের তিনটি স্তর – বৈদিক পৌরাণিক ও লৌকিক

এককথায় অভিজাত পৌরাণিক শিবচেতনার সংস্কার প্রবেশ আর শিবায়নে বাংলার কৃষিজীবী সমগ্র লৌকিক জীবনটি লৌকিক জীবনে রূপান্তরিত হয়েছে । তবে শিবের উদভবের আদিম লোকিক সমাজের অন্তস্থল থেকে – তা সম্পূর্ণ সংকেতবাহী।

আলোচক – প্রিয়াংকা সরকার, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *