রূপতত্ত্ব

কারক বিভক্তি ও অনুসর্গ

পাণিনি বলেছেন ‘ক্রিয়াণ্বয়ী কারকম্‌’। ক্রিয়ার সঙ্গে অণ্বয় থাকবে। এখন প্রশ্ন হল এই অণ্বয় কীসের ? আমাদের উত্তর এই অণ্বয় বাক্যস্থ ক্রিয়ার সঙ্গে ঐ বাক্যের অন্যান্য নামপদের।  আর এই সম্পর্ককেই কারক বলে। কারক নির্ণয়ের জন্য বাক্যের ক্রিয়াকে ‘কে’ ‘কী’ ‘কোথায়’ ‘কোথা থেকে’ ইত্যাদি দিয়ে প্রশ্ন করতে হয়।

কারককে আমরা ছয়টি শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি। – কর্তৃকারক, কর্মকারক, করণ কারক, নিমিত্ত কারক, অপাদান কারক এবং অধিকরণ কারক। এই ছয়টি বিভাগ ছাড়া আছে দুটি অকারক পদ – সম্বন্ধ পদ ও সম্বোধন পদ।  এখন এই শ্রেণিগুলি সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা নেওয়া যাক।

কর্তৃকারক

‘কর্তৃ’ শব্দটির আড়ালে আছে ‘কর্তা’। আর বাক্যের কর্তা  তিনিই  যিনি  কোনো কাজ সম্পন্ন করেন। ক্রিয়ার সাথে বাক্যের যে পদের কর্তৃ সম্বন্ধ আছে সেই পদটিই হবে কর্তৃকারক। কর্তৃকারক নির্ণয়ের জন্য বাক্যস্থ ক্রিয়াকে ‘কে’ দিয়ে প্রশ্ন করতে হয়।

যেমন – রাজা দান করেন। এই বাক্যে ক্রিয়াটি সম্পন্ন করছে ‘রাজা’। বাক্যের ক্রিয়া ‘করেন’কে ‘কে ?’ দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে ‘রাজা’। তাই পদটির কারক কর্তৃকারক।

কর্মকারক

বাক্যের কর্তা যে কাজ করেন তাকে কর্ম বলে। ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের যে পদটি কর্ম সম্বন্ধ যুক্ত তাকেই কর্মকারক বলে। এই কারক নির্ণয়ে বাক্যের ক্রিয়াকে ‘কী’ বা ‘কাকে’ দিয়ে প্রশ্ন করতে হয়।

যেমন – রাজা স্ত্র দান করেন। এই বাক্যে ক্রিয়া ‘করেন’ কে ‘কী’ দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে ‘বস্ত্র’।

করণ কারক

বাক্যের কর্তা যার দ্বারা কোন কাজ সম্পন্ন করে থাকেন তাকেই করণ বলে। বাক্যের ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যস্থ যে পদের করণ সম্পর্ক থাকে তাকেই করণ কারক বলে। করণ কারক নির্ণয়ে বাক্যের ক্রিয়াকে ‘কী দ্বারা’, ‘কী দিয়ে’ ‘কীসের দ্বারা’ দিয়ে প্রশ্ন করতে হয়।

যেমন – রাজা নিজ হস্তে বস্ত্র দান করেন। এই বাক্যে ক্রিয়া ‘করেন’ কে ‘কী দিয়ে’ বা ‘কী দ্বারা’ দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে ‘হস্ত’। অতএব ‘হস্ত’ হল করণ কারক।

নিমিত্ত কারক

বাক্যের কর্তা যখন কারো জন্য কিছু করে থাকেন তখন তা নিমিত্ত হয়। বাক্যের ক্রিয়ার সঙ্গে যে পদের এই সম্বন্ধ তাকেই নিমিত্ত কারক বলে। এই কারক নির্ণয়ে বাক্যের ক্রিয়াকে ‘কাদের জন্য’ বা ‘কার নিমিত্তে’ দিয়ে প্রশ্ন করতে হয়।

যেমন – রাজা নিজ হস্তে গরীব প্রজাদের বস্ত্র দান করেন। – এই বাক্যে ক্রিয়া ‘করেন’কে যদি প্রশ্ন করা হয় ‘কাদের নিমিত্তে’ বা ‘কাদের উদ্দেশ্যে’ ‘দান করেন’ ? তাহলে উত্তর আসে ‘গরীব প্রজা’। এখানে ‘গরীব প্রজা’ হল নিমিত্ত কারক।

অপাদান কারক

যা থেকে কোনো কিছু পাওয়া যায় তাকে অপাদান বলে। বাক্যের যে পদের সঙ্গে ক্রিয়ার এই অপাদান সম্বন্ধ তাকেই অপাদান কারক বলে। এই কারক নির্ণয়ে বাক্যের ক্রিয়াকে ‘কোথা থেকে’ বা ‘কী থেকে’ দিয়ে প্রশ্ন করতে হয়।

যেমন – রাজা ভাণ্ডার থেকে নিজ হস্তে গরীব প্রজাদের বস্ত্র দান করেন। বস্ত্র দান করছেন রাজা। কিন্তু ‘কোথা থেকে’ নিয়ে ? উত্তর ‘ভাণ্ডার থেকে’। এই ভাণ্ডার হল অপাদান কারক।

অধিকরণ কারক

বাক্যস্থ যে পদটি ক্রিয়ার আধার, অর্থাৎ যে স্থানে বা সময়ে বাক্যের কর্তা কোনো কাজ করে থাকেন তাকে অধিকরণ বলা হয়। ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের যে পদের অধিকরণ সম্বন্ধ তাকেই অধিকরণ কারক বলে। এই কারকে যখন কোন স্থান বোঝায় তখন হয় স্থানাধিকরণ আর যখন কোন সময় বোঝায় তখন হয় কালাধিকরণ। এই কারক নির্ণয়ে বাক্যের ক্রিয়াকে ‘কোথায়’, ‘কখন’ বা ‘কীসে’ দিয়ে প্রশ্ন করতে হয়।

যেমন – রাজা রাজসভায় ভাণ্ডার থেকে নিজ হস্তে গরীব প্রজাদের বস্ত্র দান করেন। একই ভাবে ক্রিয়াকে যদি প্রশ্ন করা হয় রাজা কোথায় বস্ত্র দান করেন ? উত্তর আসে ‘রাজসভায়’। তাই এটি অধিকরণ কারকের উদাহরণ।

সম্বন্ধ পদ

বাক্যে দুটি নামপদের মধ্যে যে সম্পর্কের যোগ তাকেই সম্বন্ধ পদ বলে। এই অকারক পদটি সাধারণত ‘র’ বা ‘এর’ বিভক্তি দ্বারা যুক্ত থাকে।

যেমন – মামার ছেলে এসেছে। এই অংশে ‘মামার’ হল সম্বন্ধ পদ। বিভক্তি -র।

সম্বোধন পদ

বাক্যে সে পদ দ্বারা কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয় তাকেই সম্বোধন পদ বলে।

যেমন – রাজা, তোর কাপড় কোথায় ?

বিভক্তি

বিভক্তি হল বর্ণ বা বর্ণ সমষ্টি যা শব্দকে পদে পরিণত করে। শব্দ যে বাক্যে বসার যোগ্যতা পায় তা এই বিভক্তির কারণে। বাংলায় ‘এ’, ‘কে’, ‘রে’, ‘তে’ ও ‘শূন্য’ এই পাঁচটি বিভক্তি পাওয়া যায়।

অনুসর্গ

বিশেষ্য বা সর্বনাম পদের পরে বসে যে সব অব্যয় বিভক্তির মত কাজ করে তাদের অনুসর্গ বলে।

যেমন – আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে। এখানে ‘থেকে’ হল অনুসর্গ।

আলোচক –  নীলরতন চট্টোপাধ্যায়