রাম বসু – মানবতাবাদী এক কবি
কবি রাম বসু মুখ্যত পরিচিত একজন কবি হিসেবে। কিন্তু শুধু কাব্য রচনাই নয়, সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর বিচরণ। তাঁর রচিত সাহিত্যে আছে মানুষের জীবনবোধের কথা, মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা। আমাদের আজকের আলোচনা রাম বসুর জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
কবি রাম বসু র জন্ম ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর, চব্বিশ পরগণার তারাগুনিয়ায়। পিতা ললিতকুমার বসু ছিলেন ঝাড়খন্ডের সিংভূম জেলার খনি অঞ্চলের কাঠের ব্যবসায়ী। মাতার নাম ইন্দুবালা। তাঁর বাল্যজীবন ও কৈশোরকাল অতিক্রান্ত হয়েছে সিংভূমের প্রকৃতিঘেরা অরণ্য অঞ্চলে। প্রাকৃতিক সুন্দরতায় ভরে ওঠে কবির কল্পনাবিলাসী শিশু মনও। বিদ্যালয়ের প্রাথমিক পাঠ ঝাড়খন্ডে হলেও পরবর্তীকালে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজের বাণিজ্য বিভাগে। কিন্তু শেষাবধি স্নাতকোত্তরের গন্ডী তাঁর পার হওয়া সম্ভব হয়নি। জীবন চলে অন্য পথে।
জীবনাদর্শ
কবির ঠাকুরদা অঘোরনাথ বসু কবিতা লিখতেন। সেই সূত্রেই রাম বসুর কবিতা লেখার প্রেরণা আসে। কলেজ জীবনেই জড়িয়ে পড়েন নানা কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সঙ্গে। পরবর্তীকালে তিনি যোগ দেন কমিউনিষ্ট পার্টির সঙ্গেও। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ভাবাদর্শেই তিনি আস্থাশীল ছিলেন। তাঁর কাব্য কবিতাতেও আছে কমিউনিষ্ট ভাবাদর্শের প্রতিফলন।
সাহিত্য জীবন
কবি রাম বসু ছিলেন ‘পঞ্চাশের দশকের এক মানবতাবাদী কবি’। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘অরণি’ পত্রিকায়। সময়কালটা হল ১৯৪৩ খ্রিঃ। যদিও পরবর্তীকালে তিনি ‘অগ্রনী’, ‘কালান্তর’, ‘গণশক্তি’, ‘যুবমানস’ প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। কবির কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৪। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল – ‘যখন যন্ত্রণা’, ‘আমি সাক্ষ্য দিই’। আছে কাব্যনাটক, যেমন – ‘মলিন আয়না’। ‘কণিষ্ক’ ছদ্মনামে লিখেছেন বেশ কিছু উপন্যাস, প্রবন্ধ। তাঁর লেখা ‘ভাষণ’, ‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’ কিংবা ‘গজেন মালী’ সমকালে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। সমকালের নিরিখে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, জেগে ওঠার কথা বলেছেন –
শাসনের মুগুর মেরে আর কতকাল চুপ করিয়ে রাখবে
এস
বাইরে এস
— ‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’
তেভাগা আন্দোলনের সময় কৃষকদের উপর জোতদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। শুধু উক্ত কবিতাই নয়, তাঁর অনেক কাব্য কবিতাই কৃষকদের উপর জমির মালিকদের অত্যাচারের কাহিনীতে বাণীরূপ লাভ করেছে। আছে দারিদ্যের কথা।
আমাদের পেটে তো ভাত নেই
পরণে কাপড় নেই
খোকার মুখে দুধ তো নেই এক ফোঁটাও”
শুধু অত্যাচারের কথা নয়, রাম বসুর কবিতা বাংলার নানা চমকারিত্বেও পূর্ণ। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের নানা প্রাকৃতিক রূপের কথাও আছে তাঁর কবিতায়। স্বরচিত কবিতা ছাড়াও তিনি অনুবাদ করেছেন হো-চি-মিনের কবিতা। তাঁর জীবনের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘যাচ্ছি যাই’ প্রকাশিত হয় ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে।
মৃত্যু
স্ত্রী অলকা বসু ও একমাত্র কন্যা সুকন্যাকে রেখে আধুনিক এই কবি ইহলোক ত্যাগ করেন ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ শে জানুয়ারি।
পুরষ্কার
রাম বসুর লেখা ‘একগুচ্ছ কাব্যনাট্য’ ১৯৮৯ খ্রিঃ রবীন্দ্র পুরষ্কার পায়। তাছাড়া তিনি ‘উল্টোরথ’ পুরষ্কারও পেয়েছেন।