বিদ্যাপতি – বাঙালির হৃদয়ের কবি
স্বয়ং শ্রীচৈতন্য দেব যাঁর পদাবলি পড়ে বুঁদ হয়ে থাকতেন তিনি ”মৈথিল কোকিল’ ও ”অভিনব জয়দেব” অভিধায় খ্যাত বিদ্যাপতি।
১৩৮০ খ্রীঃ বিহারের দ্বারভাঙ্গা র মধুবনী মহাকুমার বিসফী গ্রামে এক ব্রাহ্মন বংশে জন্মগ্রহন করেন। বিদ্যাপতি র পিতার নাম গণপতি, বিদ্যপতি -র কৌলিক উপাধি ”ঠক্কর” বা ”ঠাকুর”। হরপতি,নরপতি,বাচ্যপতি নামে তাঁর তিনপুত্রের কথা ও জানা যায়। বিদ্যপতি নিজ প্রতিভার গুনে ”মিথিলা” রাজবংশের রাজা কীর্ত সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।এছাড়া রাজা শিবসিংহ, রাজা দেবী সিংহ এবং রাণী লছমী দেবীর পৃষ্ঠপোষকতা য় বিদ্যপতি মৈথিল,সংস্কৃত,ও অবহট্ট ভাষায় বহু পদ রচনা করেন।
এবার একনজরে দেখে নেওয়া যাক কোন রাজার পৃষ্টপোষকতায় বিদ্যপতি কি কি কাব্য রচনা করেন:-
(১) কীর্তিসিংহ- ‘কীর্তিলতা’
(২) দেবসিংহ- ‘ভূ-পরিক্রমা’
(৩) শিবসিংহ -‘ কীর্তিপতাকা’
(৪) পুরাদিত্য -‘ লিখনাবলী’
(৫)ভৈরবসিংহ -‘ দুর্গাভক্তি তরঙ্গীনি ‘
(৬)নরসিংহ -‘দানবাক্যাবলী
(৭) পদ্মসিংহ ‘শৈবসর্বস্বহার’
বিদ্যপতি মিথিলার কবি প্রথম প্রমান করেন জন বীমস সাহেব।যদিও ১৮৭৫খ্রীঃ রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রমাণ করার চেষ্টা করেন বিদ্যাপতি মিথিলার কবি নন। জীবনরসিক কবি বিদ্যাপতি। তাঁর কাব্যে সুখ দুঃখ সমান ভাবে পরিবেশিত। বিদ্যাপতি রাজসভার কবি তাই তাঁর রাধার মধ্যে কামনা বাসনা মিলন বিরহ প্রভৃতি উচ্ছ্বাস গুলি ফুটে উঠেছে। বয়ঃসন্ধির পদে দেখা যায় রাধা:-
”কবহ বাঁধয় কচ কবহু বিথারি।
:কবহ ঝাঁপয় অঙ্গ কবহু উঘারি।
পাশাপাশি পূর্বরাগ ও অভিসার পর্যায়ের পদেও বিদ্যপতির কৃতিত্ব যথেষ্ট।
মাথুর পর্যায়ে দেখি শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় চলে গেলে রাধার করুণঅার্তি :-
”শুন ভেল মন্দির শুন ভেল নগরী।
শুন ভেল দশ দিশ শুন ভেল সগরী।।
প্রার্থনা পর্যায়ের পদেও বিদ্যাপতির শ্রেষ্টত্ব শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় :-
”মাধব বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসি তিল। এ দেহ সমর্পিঁলু
দয়া জনু ছোড়বি মোয়”
স্বয়ং চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদে পরম তৃপ্তি পেতেন। অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ প্রসাদ বসু বিদ্যাপতিকে ”কবিসার্বভৌম্য” বলেছেন। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়- বলেছেন ”Cosmic imagination”র কবি বিদ্যাপতি।
বিদ্যপতি র রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদের সংখ্যা পাঁচ শতের ও বেশি।
বিদ্যপতির পদে ”শৃঙ্গার” রসের প্রাচুর্য পরিলক্ষিত হয়।
বিদ্যপতি নিজেকে ”কীর্তিলতা ” গ্রন্থে ”খেলন কবি” বলেছেন। সমাজজীবনে বিদ্যাপতির পদগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।
বিদ্যাপতির
”দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী” বই তে দুর্গাপূজা র নিয়মকানন অাছে।
এছাড়া ”ভূপরিক্রমা” বই তে জমি জরিপ সংক্রান্ত নিয়মের পরিচয় পাওয়া যায়।
”গঙ্গাবাক্যাবলী ” তে গঙ্গাতীরবর্তী তীর্থ মহিমার কথা জানা যায়।
শব্দঝংকার ও ছন্দের কারুকার্যে বিদ্যাপতি র অবদান অপরিসীম।
ক্ষুদ্র কবিতার মধ্যে অপুর্ব ব্যঞ্জনা
সৃষ্টি করে বিদ্যাপতি কবিচাতুর্যের পরিচয় দিয়েছেন।
সবশেষে অাচার্য দীনেশচন্দ্র সেন র মন্তব্য দিয়ে শেষ করা যেতে পারে-
” বিদ্যপতির পদাবলী মধুচক্রের মত-ইহার কুহরে কুহরে মাধুর্য”