করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় – জীবন ও সাহিত্য
রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম হলেন করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭ – ১৯৫৫)। তাঁর কাব্য-কবিতায় আছে বাংলাদেশের প্রকৃতির কথা, স্বদেশপ্রেমের পরিচয়। আমাদের এই আলোচনায় কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় -এর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর (১২৮৪, ৫ই অগ্রহায়ণ) সোমবার নদিয়ার শান্তিপুরে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কবির আত্মজীবনস্মৃতির পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায়, ঐ দিনটি ছিল শুক্লা চতুর্দশী, রাস পূর্ণিমার পূর্বদিন। কবির পিতার নাম নৃসিংহচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল হুগলির গুপ্তিপাড়া গ্রামে। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ায় কবির পিতামহ চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিপুরে চলে আসেন। সেই থেকেই তাঁরা ওখানেই বসবাস করতে থাকেন। কবির মাতামহ কালিদাস বিদ্যাবাগীশ ছিলেন সংস্কৃত শাস্ত্রের সুপণ্ডিত ব্যক্তি। ১৩০৯ বঙ্গাব্দে খড়দহের লালবিহারী মুখোপাধ্যায়ের পরমাসুন্দরী কন্যা ধরাসুন্দরী দেবীর সঙ্গে কবির বিবাহ হয়। উভয়ের পুত্রের নাম বাসুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
শিক্ষা
পাঁচ বছর বয়সে কবির হাতে-খড়ি হয়। পরে পিতামহ চন্দ্রনাথের চেষ্টায় লেখাপড়া শেখার উদ্দেশ্যে কলকাতার ডাফ্ স্ট্রিটের বাড়িতে চলে আসেন। কলকাতায় থাকাকালীন হাতিবাগান লেনে এক গুরুমশায়ের পাঠশালায় কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। এরপর কবির যখন ছয় বছর বয়স, তিনি ভর্তি হন জেনারেল এসেম্বলিজ ইনষ্টিটিউশানে ইনফ্যান্ট ক্লাসে। মাতুল রামনাথের নিকট তাঁর সংস্কৃত চর্চা শুরু হয়। পরে কবির পিতা পুত্রের শিক্ষার জন্য নিয়ে আসেন গোবিন্দপুরে। এখানেই পিতার নিকট শুরু হয় তাঁর ইংরেজি পাঠ। শুধু তাই নয়, প্রকৃতির সঙ্গে কবির প্রথম সংযোগ এই গোবিন্দপুরে থাকাকালীনই। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে করুণানিধান শান্তিপুর মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন।
সাহিত্য জীবন
কবির কাব্যানুরাগের সূচনা মাতুল রামনাথের নিকট থেকে। কিশোর কবি মাত্র এগারো বছর বয়সে পঞ্চকোটে সর্বপ্রথম কবিতা রচনা করেন। প্রথম কবিতাটি ছিল একটি পর্বতের বর্ণণা। কবির আত্মস্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘ভোলা কথা’য় তিনি লিখেছেন –
দশ-এগার বৎসর বয়সেই কবিতা লেখার ঝোঁক হয়। বন-পাহাড় দেখতে দেখতে মানিভূম জেলায় দারুকেশ্বর নদের উঁচু-নীচু তীরে বসে চৌদ্দ অক্ষর গুনে গুনে পদ্য লিখে লিখে শোনাতাম খেলার সাথীদের।
কবির প্রথম মুদ্রিত কবিতার নাম ‘সিন্ধুতটে’। কবিতাটি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানেন্দ্রনাথ দাস সম্পাদিত ‘সময়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর ‘বিংশ শতাব্দী’, ‘ভারতী’, ‘সাহিত্য’ প্রভৃতি পত্রিকায় কবির কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে।
করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দশটি। এর মধ্যে আটটি কাব্যগ্রন্থ কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত। দুটি কাব্যের পাণ্ডুলিপি কবির মৃত্যুর পর পাওয়া যায়। নীচে কবির কাব্যগ্রন্থগুলির পরিচয় দেওয়া হল –
কাব্য পরিচয়
১. বঙ্গমঙ্গল (১২০১) – কাব্যটি কবির প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। স্বদেশি আন্দোলনের চার বছর পূর্বে এই কাব্য রচিত হয়। ‘বঙ্গমঙ্গল’ স্বদেশপ্রেমের কাব্য। কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা হল ‘বন্দনা’, ‘কোলাকুলি’, ‘আশীর্বাণী’, মিলন’। কাব্যে বিহারীলাল চক্রবর্তী, অক্ষয়কুমার বড়াল, দেবেন্দ্রনাথ সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কাব্যটির প্রথম সংস্করণ হয় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ হয়েছিল যথাক্রমে ১৯০৫ ও ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে।
২. প্রসাদী (১৯০৪) – কাব্যে মোট ২১টি কবিতা আছে। কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা হল ‘প্রবেশ’, ‘দিনান্ত মেঘে’, ‘বালুকায়’, ‘আবাহন’, ‘দেবোদ্দেশে’। কাব্যটির দ্বিতীয় সংস্করণ হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। কাব্যটি সতীশচন্দ্র বাগচীকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
৩. ঝরা ফুল (১৯১১) – এই বছর কবির বাল্যবন্ধু অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ কাব্যটির প্রকাশ করেন। কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা হল ‘ঝরা ফুল’, ‘শেফালি’, ‘বিংশ শতাব্দীর মেঘদূত’, বন্দনা’, ‘সমর্পণ’। কাব্যটির দ্বিতীয় সংস্করণ হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে।
৪. শান্তিজল (১৯১৩) – কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা হল ‘চিরসুন্দর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘অতীত’, ‘শান্তি’
৫. ধানদূর্বা (১৯২১) – কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা হল ‘নববর্ষ’, ‘মঙ্গলগীতি’, ‘জীবন ভিক্ষা’, ‘বসন্ত বিলাস’, ‘লুকোনো ছবি’, ‘মাতৃস্তোত্র’
৬. শতনরী (১৯৩০) – কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা হল ‘ফিরে চাওয়া’, ‘সে’, ‘পঞ্চকোটে’, অমিতাভ’)
৭. রবীন্দ্র আরতি (১৯৩৭) – কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা হল ‘রবীন্দ্র আরতি’, ‘ত্রিকূটে’, ‘প্রবাসী’, ‘আবছায়ায়’)
এছাড়া গীতায়ন (১৯৪৯), গীতারঞ্জন (১৯৫১), শেষ পসরা (অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি)
ফাল্গুন, ১৩৬০ বঙ্গাব্দে রঞ্জন হাউস থেকে প্রকাশিত সজনীকান্ত দাসের ভূমিকাসহ করুণানিধানের তিনটি কাব্য ‘বঙ্গমঙ্গল’, ‘প্রসাদী’ ও ‘ঝরাফুল’ একত্রে ‘ত্রয়ী’ নামে প্রকাশিত হয়।