উইলিয়াম কেরী – বাংলা সাহিত্যে গদ্যরীতির প্রবর্তক
বাংলা সাহিত্যে গদ্যরীতির প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত উইলিয়াম কেরী (১৭ অগস্ট, ১৭৬১ – ৯ জুন, ১৮৩৪)। বর্তমান বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। আমাদের এই আলোচনা কেরী সাহেবকে নিয়েই, তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে।
১৭৯৩ সালে বাংলায় এসেছিলেন উইলিয়াম কেরী । ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক কাজ কিংবা শুধু ধর্ম প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না তার কর্মকান্ড। অনন্য এক কীর্তির জন্যে তিনি আজও অমর হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যে গদ্যরীতির প্রবর্তন। তিনিই পদ্যের গঠনে বাংলা ভাষা রীতির প্রচলন ভেঙে গদ্য ব্যবহার শুরু করেন। তিনি এ অঞ্চলে কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বাংলা ভাষায় বেশ কিছু পুস্তক রচনা করেন। যার মধ্যে গদ্য ছাড়াও পদ্য ও গীতিও রয়েছে।
প্রাক কথা
এডমন্ড ও এলিজাবেথ কেরির পাঁচ সন্তানের মধ্যে উইলিয়াম কেরী ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ। তাঁর পিতামাতা ছিলেন নরদাম্পটনের পলারসপ্যুরি গ্রামের তন্তুবায়। বাল্যকাল থেকেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, বিশেষত উদ্ভিদবিদ্যায় কেরির গভীর আগ্রহ ছিল। স্বচেষ্টায় তিনি লাতিন শিখেছিলেন। ১৭৯২ সালে তাঁর বিখ্যাত পুস্তিকা ‘অনুসন্ধান’ প্রকাশিত হয়। এতে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ধর্মীয় মতবাদ পূর্ববর্তী প্রচেষ্টা ও এ বিষয়ে কৃতকার্যতা এবং আরও দায়িত্ব গ্রহণের সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেন। এ বছর ৩১ অক্টোবর চালক সংঘের সভায় ‘প্রথম ইংলিশ মিশনারী’ সোসাইটি স্থাপিত হয়।
কেরী সাহেবের এদেশে আগমন
১৭৯৩ সালের ১৩ জুন উইলিয়াম কেরী তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ফিলিক্স, স্ত্রী ও কন্যাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ১১ নভেম্বর তিনি ও তার সহযাত্রীগণ কলকাতায় অবতরণ করেন। তখন তার বয়স মাত্র ৩১ বছর। এখানে তিনি একটি অবৈতনিক দৈনিক পাঠশালা খোলেন ১৭৯৩ সালে। এ সময় তিনি হিন্দু মুসলমান যুবকদের জন্যে মদনাবাটিতে একটি এবং রামপাল দীঘিতে একটি কলেজ স্থাপন করার চিন্তা প্রকাশ করেন।
১৭৯৬ সালের গ্রীষ্মে উইলিয়াম কেরী ৩ বৎসরের কম সময়ের মধ্যে বাইবেলের নতুন নিয়মের অনুবাদ প্রায় শেষ করেন। পেন্টাটিউকের এর বেশ খানিকটা অংশও তিনি এ সময় অনুবাদ করেন। ১৭৯৮ সালে তিনি শ্রীরামপুর ছাত্রাবাস স্থাপন করেন। ১৮০০ সালে স্থাপন করেন শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্টমিশন। এ বছর ৫ মার্চ সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় নতুন নিয়ম ছাপিয়ে প্রকাশ করেন। এটিকে বাংলা ভাষার প্রথম গদ্য সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও এ বছর তিনি বালকদের জনে প্রথম অবৈতনিক দৈনিক স্কুল স্থাপন করেন এবং পুরাতন নিয়মের মাত্র দুটো পুস্তক ছাড়া সম্পূর্ণ বাইবেল অনুবাদ শেষ করেন।
কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার শিক্ষক নিযুক্ত হন ১৮০১ সালের মে মাসে। আগস্ট মাসে কেরীর লেখা কথোপকথন প্রকাশিত হয়। এটি ইংরেজীতে dialogoues বা Colloguies নামে বিখ্যাত। এ বছরই বাংলা ব্যাকরণ বইটি প্রকাশিত হয় ১৮০৬ সালের হিন্দি, উড়িয়া, মারাঠি ও সংস্কৃত ভাষায় নতুন নিয়ম অনুবাদ করতে আরম্ভ করেন। ফলে কেরীর জীবিত অবস্থায় ৩৪টি ভাষায় সম্পূর্ণ বাইবেল অথবা বাইবেলের অংশ বিশেষ অনূদিত হয়। এ বছরই এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে সভ্যপদ দান করে। বাউন ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মান সূচক ডক্টর অফ ডিভিনিটি ডিগ্রি প্রদান করে ১৮০৭ সালে। এ বছর তার প্রথম স্ত্রী ডরোথী প্লাকেট রোগে মৃত্যুবরণ করেন। পরের বছর তিনি সার্লট রুউমোরকে বিয়ে করেন।
কর্ম ও সাহিত্য
১৮০৯ সালে পূর্ণাঙ্গ বাইবেলটি বাংলা ভাষায় ছাপানো হয়। এছাড়াও এ সময় অনুবাদ কাজে তার যথেষ্ট অগ্রগতি দেখা যায়। ১৮১২ সালের ১১ মার্চ সন্ধ্যায় তার প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর ছাপাখানায় আগুন লাগে। এতে পুস্তক, অনুলিপি, টাইপসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এ সংবাদ কলকাতা পৌঁছাবার পর এক সপ্তাহের মাঝে সেখান থেকে আট হাজার দুইশত টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। ইংল্যান্ডে খবর যাবার দুই মাসের মধ্যে প্রায় এক লাখ ৪২ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়। এ বছরই কেরীর ইতিহাসমালা পুস্তকটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে ১৫০টি শিরোনামের নানা স্থানের ১৪৮টি গল্প মুদ্রিত হয়।
ভারতবর্ষের জনসাধারণের জন্যে বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব Plan for instructing native inhabitants of India in European Sciences সরকারের কাছে পেশ করেন ১৮১৪ সালে। দেশীয় ছাত্রদের মাঝে পুস্তকের অভাব মেটানোর উদ্দেশ্যে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপিত হয় ১৮১৭ সালে। উইলিয়াম কেরী র নেতৃত্বে ৪ জন বাঙালী হিন্দু, ৪ জন মৌলভী ও বাকি ১৬ জন ইউরোপীয় নিয়ে এর পরিচালক সমিতি গঠিত হয়। ১৮১৮ সালে তিনটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলো হচ্ছে দিকদর্শন নামে একটি বাংলা মাসিক, সমাচার দর্পণ নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক এবং Friends of India নামে একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক।
এ বছর শ্রীরামপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুল পরিচালনার জন্য কলকাতা স্কুল সোসাইটি স্থাপিত হয়। স্কুল কলেজের জন্যে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নের জন্যেও কেরী কাজ শুরু করেন। ভারতে স্ত্রী শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে এবং সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে তিনি বিশেষভাবে তৎপর হন।
১৮১৯ সালের বড়লাট পত্নী লেডি হেস্টিংসের উৎসাহে উইলিয়াম কেরী সর্বপ্রথম কৃষি সমিতি স্থাপন করেন। কয়েকটি স্থানে এই সমিতির আদর্শ কৃষি উদ্যান ছিল। কেরীর দ্বিতীয় স্ত্রী সার্লট মারা যান ১৮২১ সালে।
জীবনে প্রতিঘাত ও জীবনাবসান
তার জীবনে দুটো বড় ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটে ১৮২২ সালে। এ বছর তিনি তার যোগ্য পুত্র ফেলিক্স কেরীকে হারান এবং তার বহু পরিশ্রমের ফসল ইউনিভার্সাল ডিকশেনারি বা ভারতীয় ১৩টি প্রধান ভাষার সর্বশব্দ কোষ আগুনে পুড়ে যায়।
১৮২৯ সালে ৫ ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন জারি করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন এবং ঐ দিনই এই আইনের বাংলা অনুবাদের জন্যে বিশেষ দূতের মাধ্যমে কেরীর কাছে পাঠান। বৃদ্ধ কেরী সারাদিন ধরে এটি অনুবাদ করে নিজেই বেন্টিঙ্কের হাতে পৌঁছে দেন এবং যে দিন কোন উপাসনায় যোগ না দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে কলকাতার আশেপাশের লোকদের এই আইনের কথা জানান। কেরী ৩১ বছর যে কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন সেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজটি বন্ধ হয়ে যায় ১৮৩০ সালে।
১৮৩২ সালে ৭১ বছর বয়সেও কেরী নিয়মিত প্রচার বাংলা ইংরেজীসহ ভারতের বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য চর্চা বক্তৃতা ও বাইবেল অনুবাদ অব্যাহত রাখেন। উইলিয়াম কেরী নামের বাংলা প্রেমিক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের মহান কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৮৩৪ সালের ৯ জুন ৭৩ বছর বয়সে। তাকে সমাহিত করা হয় শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীদের সমাধি ক্ষেত্রে।
উইলিয়াম কেরী -এর রচনা তালিকা
উইলিয়াম কেরী রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ (১৮০১ সালে ইংরেজি ভাষায় রচিত), ডায়ালোগস (বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক গ্রন্থ, ১৮০১), ইতিহাসমালা (গল্পসংগ্রহ, ১৮১২), বাংলা-ইংরেজি অভিধান (১৮১৫-২৫), চার খণ্ডে ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ধর্মপুস্তক (১৮০২-০৯, হিব্রু থেকে অনূদিত)। এছাড়া তিনি মারাঠি ব্যাকরণ ও অভিধান এবং পাঞ্জাবি ব্যাকরণ, তেলিঙ্গা ব্যাকরণ, কানাড়ি ব্যাকরণ প্রকাশ করেন। তিনি ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত ও অসমিয়া ভাষায়ও বাইবেল অনুবাদ করেন। জোশুয়া মার্শম্যানের সঙ্গে মিলে তিনি মূল বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যাকান্ড পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে তিন খণ্ডে প্রকাশ করেন। ‘এ ইউনিভার্সাল ডিকশনারি অফ দি ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজেস’ নামের সংস্কৃতসহ ১৩টি ভারতীয় ভাষায় এক সমন্বিত শব্দকোষ কেরির অসামান্য পাণ্ডিত্যের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এই শব্দকোষের পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ অগ্নিকাণ্ডে বিনষ্ট হওয়ায় এর মুদ্রণ সম্পন্ন হতে পারেনি। উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষায় ‘কথোপকথন’ (১৮০১) ও ‘ইতিহাসমালা’ (১৮১২) গ্রন্থ রচনা করেন। ওই সময় তার উদ্যোগে ৪০টি ভাষায় খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ হয়।
তিনি বাংলা হরফের সংস্কার, অন্যান্য ভারতীয় ভাষার হরফ তৈরি করেন। রচনা করেন বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা-ইংরেজি অভিধান। তার উদ্যোগে ১৮১৮ সালে ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। পুস্তক রচনা, অনুবাদ ও প্রকাশের পাশাপাশি বাংলা হরফের সংস্কার এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় হরফ তৈরির কাজেও তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।