রূপতত্ত্ব

বাংলা শব্দের গঠনবৈচিত্র্য

শব্দ কিভাবে গঠিত হয় এবং বাক্যে ব্যবহৃত হবার সময় কিভাবে তার রূপবৈচিত্র্য ঘটে , এই বিষয় দুটিই বাংলা রূপতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় । তাঁর আগে জেনে নেওয়া যাক শব্দ কাকে বলে ?

শব্দের সংজ্ঞা  যখন কোনো ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি স্বাধীনভাবে অর্থ প্রকাশ করতে সমর্থ হয় , তাকে শব্দ বলে ।

শ্রেণী  গঠনগত দিক থেকে বাংলা শব্দ তিন প্রকার । যথা –

১) সিদ্ধশব্দ  যে শব্দ একটিমাত্র রূপিম নিয়ে গঠিত হয় , তাকে সিদ্ধশব্দ বলে ।
উদাহরণ – মা, পুত্র, গৃহ, আকাশ ইত্যাদি ।

২) জটিল শব্দ  যে শব্দ এক বা একাধিক মুক্ত রূপিমের সঙ্গে এক বা একাধিক বদ্ধ রূপিমের সংযোগে গঠিত , তাকে বলা হয় জটিল শব্দ ।
উদাহরণ – গমন, পন্ডিতী, নাটুকে, গ্রাম্য ইত্যাদি ।

৩) সমাসবদ্ধ শব্দ  যে সব শব্দ একাধিক মুক্ত রূপিম বা একাধিক শব্দ নিয়ে গঠিত , তাদের সমাসবদ্ধ শব্দ বলে ।
উদাহরণ :- ভাইবোন, বাবামা, রাজপুত্র, আত্মীয়স্বজন ইত্যাদি ।

বাংলা শব্দের গঠনবৈচিত্র্য নির্ভর করে মূলত কারক , বচন , লিঙ্গ , কাল , ভাব ইত্যাদির উপর । এগুলিকে ব্যাকরণিক সংবর্গ বলা হয় ।

কারক  বাক্যের ক্রিয়ার সঙ্গে বিশেষ্য ও সর্বনামের যে সম্পর্ক , তাই হল কারক । এই সম্পর্ক বোঝাবার জন্য কিছু চিহ্ন ব্যবহৃত হয় , যাদের কারকবিভক্তি বলা হয় । ক্রিয়ার সঙ্গে বিশেষ্য ও সর্বনাম পদগুলির ছয় রকম সম্পর্ক হতে পারে । তাই , ছয় প্রকার কারকের কথা বলা হয় । এই ছয় প্রকার কারক ছাড়াও সম্বন্ধ পদ এবং সম্বোধন পদেরও অস্তিত্ব আছে , তাদের চিহ্নিত করার জন্য বিভক্তিও আছে । সাধারণত , কর্তৃ কারকে শূন্য বিভক্তি , কখনো ‘এ’ বিভক্তি হয় , কর্মকারক ও সম্প্রদানে ‘কে’ , ‘রে’ , ‘য়’ বিভক্তি হয় । করণ কারকে ‘এ’ , ‘তে’ হয় , এছাড়া ‘দ্বারা’ , ‘দিয়া’ ইত্যাদি অনুসর্গও হয় । অপাদানেও ‘হইতে’ , ‘চেয়ে’ ইত্যাদি অনুসর্গ ব্যবহৃত হয় । অধিকরণে ব্যবহৃত হয় ‘এ’ , ‘তে’ , ‘য়’ ইত্যাদি বিভক্তি । সম্বন্ধ পদে ব্যবহৃত হয় ‘র’ ,’এর’ বিভক্তি । বাংলা সম্বোধন পদে কোনো পৃথক বিভক্তি ব্যবহৃত হয় না ।

বচন  শব্দের রূপবৈচিত্র্য ঘটাতে বাংলা ভাষায় বচনের ভূমিকা এখনো শক্ষ্যণীয় । বচন দুই প্রকার – একবচন ও বহুবচন । একবচনের কোনো চিহ্ন নেই । বহুবচন বোঝাতেই চিহ্ন ব্যবহৃত হয় । যেমন – ‘ছেলেরা’ , ‘আমরা’ , ‘তারা’ ইত্যাদি । অপ্রাণীবাচক বিশেষ্যের শেষে ‘গুলি’ , ‘গুলো’ , ‘গুলা’ ব্যবহৃত হয় । প্রাণীবাচক পদের শেষে ‘দল’ , ‘বৃন্দ’ , ‘সকল’ , ‘সমূহ’ , ‘গণ’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয় । কখনো বা বহুবচন বোঝাতে শব্দ-দ্বৈত ব্যবহার হয় । যেমন – ‘নদী-নালা’ , ‘গাছ-পালা’ , ‘ঘর-বাড়ি’ ইত্যাদি ।

লিঙ্গ  বাংলা ভাষার রূপতত্ত্বে লিঙ্গের ব্যবহার ক্রমশ কমে আসছে । ঐতিহ্য মেনে কিছু কিছু বিশেষ্য ও বিশেষণ পদের লিঙ্গ অনুযায়ী রূপগঠন হয় । স্ত্রীলিঙ্গ বোঝাবার জন্য কিছু চিহ্ন শব্দের শেষে যুক্ত করা হয় । যেমন – ‘আ’ – কান্ত > কান্তা , ‘ঈ’ – গোপ > গোপী , ‘ইকা’ – বালক > বালিকা , ‘ইনী’ – রাগ > রাগিনী ইত্যাদি । তাহলে , এখান থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে লিঙ্গের পরিচয় বোঝাবার জন্য শব্দের রূপ বদল করা হয় । তবে সংস্কৃতে এটা যতটা গুরুত্ব পেত বাংলাতে ততটা পায় /পাচ্ছে না ।

কাল  ক্রিয়পদের রূপবৈচিত্র্য ঘটাতে ‘কাল’ এর ভূমিকা এবং ‘পুরুষ’ এর ভূমিকা অনস্বীকার্য । একই কালে তিন পুরুষের জন্য তিন রকম ক্রিয়াবিভক্তি প্রচলিত আছে । যেমন – বর্তমান কালের উওম পুরুষের ক্রিয়াবিভক্তি ‘ই’ – ‘আমি খাই’ । মধ্যম পুরুষের বিভক্তি ‘ও’ – ‘তুমি খাও’ । প্রথম পুরুষের বিভক্তি ‘এ’ , ‘য়’ – ‘সে করে’ , ‘সে খায়’ । অতীত , ভবিষ্যৎ বা অন্যান্য কালের জন্যেও নানারকমের চিহ্ন বা বিভক্তি ব্যবহৃত হয় , ফলে ক্রিয়াপদের রূপবৈচিত্র্য সৃষ্টি হয় ।

ভাব  ভাবের প্রভাবেও ক্রিয়াপদের তথা শব্দের রূপবৈচিত্র্য ঘটে । তবে বিবৃতিমূলক ভাব বা অনুজ্ঞামূলক ভাবের জন্য ক্রিয়াপদের পার্থক্য যতটা স্পষ্ট , অপেক্ষিত ভাবের জন্য ততটা নয় । বিবৃতিমূলক – ‘সে পড়ে’ । অনুজ্ঞামূলক – ‘সে পড়ুক’ ।

কাজেই , বোঝা গেল কারক , বচন , লিঙ্গ , পুরুষ , কাল , ভাব – এসবের উপর নির্ভর করেই শব্দের বা পদের রূপবৈচিত্র্য ঘটে ।

লিখেছেন – সাহেব দাঁ, বাংলা ছাত্র, পুরুলিয়া 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *