শৈলিবিজ্ঞান

শৈলী বিজ্ঞান – বিচ্যুতি

এঙ্কভিস্ট বলেন, শৈলী হল নর্ম থেকে বিচ্যুতি। Style…as deviation from norm. যা কিছু প্রচলিত, রীতিসিদ্ধ এবং স্বাভাবিক তা থেকে সরে যাওয়ার মাধ্যমে শিল্পের প্রকাশ। শিল্পের অনিবার্য লক্ষণই হল প্রথাসিদ্ধ রূপ থেকে বিচ্যুতি।

যেমন –

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি (বিচ্যুত রূপ)
আমি হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি (আদর্শ রূপ)

ঘরে তে এলো না সে তো। (বিচ্যুত রূপ)
সে তো ঘরে তে এলো না। (আদর্শ রূপ)

ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে। (বিচ্যুত রূপ)
ভ্রমর ঘরেতে গুনগুনিয়ে এল। (আদর্শ রূপ)

আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরন খেলা। (বিচ্যুত রূপ)
আমি আজিকে পরানের সাথে মরন খেলা খেলিব। (আদর্শ রূপ)

এর বিপরীত দিকে হল antomatization বা বাঁধাধরা পথ চলা। বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের কবিতাগুলি বাঁধাধরা পথে চলেছে। কথার সাথে সুর মিশে ছিল। মধুসূদন প্রথম কথাকে আলাদা করে নিলেন। আর বাঁধাধরা পথ থেকে সরে এলেন। তার কাব্যে তাই পাওয়া গেল ‘বিচ্যুতি’। এভাবেই কবিতার বাঁক তৈরী হল।

বিচ্যুতির শ্রেনীবিভাগ

বিচ্যুতি মূলত দুই প্রকার।  ক) বহির্গঠনের বিচ্যুতি এবং খ) অন্তর্গঠনের বিচ্যুতি।

বহির্গঠনের বিচ্যুতি :
যা প্রধানত আন্বয়িক (Syntactic), ব্যাকরনিক বা শব্দজাত। তবে এ ছাড়াও ধ্বনিগত, লৈখিক ও উপভাষিক প্রভৃতি নানা বিচ্যুতি বহির্গঠনের সাথে যুক্ত।

অন্তর্গঠনের বিচ্যুতি :
বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থের বিচ্যুতির সঙ্গে সম্পর্কিত।

অন্যান্য বিচ্যুতি

ক. শব্দগত বিচ্যুতি :
শব্দের অভিনব প্রয়োগ কবিতার ভাষায় নতুন মাত্রা এনে দেয়।সম্পূর্ন অপ্রচলিত শব্দ কবিতায় ব্যবহার করে সাধারণ ভাবে স্বীকৃত ও প্রচলিত রীতির ব্যত্যয় ঘটাতে পারেন কবি।

সিদ্ধির ‘অঙ্কুটে’ / সোনার স্বর্গের দ্বার খুলিত না তবু

কৃষ্ণপদে নেত্র বুজে ফেলিনিকো থিয়েটারি ‘লোহু’।

শস্য ‘ফলিয়া গেছে’ / রয়েছে দাড়ায়ে

‘জাগিয়া রয়েছে’ তব প্রেত-আখি প্রেমের প্রহরা

খ. ব্যাকরণগত বিচ্যুতি :
শব্দ গঠনের স্তরে বা কাব্যিক অবয়বেও ঘটতে পারে বিচ্যুতি।

১. রূপতাত্ত্বিক বিচ্যুতি :
শব্দ গঠনের স্তরে প্রচলিত নিয়ম কবি ভেঙ্গে ফেলতেই পারেন।
উদাহরণ –
‘প্রাকপুরানিক’ বাল্যবন্ধু যত / বিগত সবাই (পৌরাণিক)

‘ অনুতম’ পরমানু আপনার ভাবে (অনু বিশেষ্য হলেও বিশেষনিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে)

অগণন ‘ভিড়াক্রান্ত’ হে শহর (তদ্ভব +তৎসম)

বুদ্ধি আমার ‘অপাপবিদ্ধমস্নাবির’ (বাংলা বাক্যে সংস্কৃত সমাসবদ্ধ পদ)

২. অন্বয়িক বিচ্যুতি :
ভাষার পদক্রমের যে নির্দিষ্ট রীতি আছে তার বিপর্যাস ঘটানো কবিতার এক অন্যতম লক্ষন। ক্রিয়াপদের পূর্ব ব্যবস্থাপনা, বিশেষ্য-বিশেষনের স্থান পরিবর্তন বা যৌগিক ক্রিয়ার দুরান্বয় প্রভৃতি কৌশলের মাধ্যমে কাব্যিক বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়।

আমরা ‘বেসেছি’ যারা অন্ধকারে শীত রাত্রিটিরে ‘ ভাল’।

‘জাগায়ে’ মাধবীবন ‘চলে গেছে’ বহুক্ষণ / ‘প্রত্যুষ নবীন’।

৩. অর্থগত বিচ্যুতি :
শব্দকে কবি নতুন এবং অভিধানে অলভ্য অর্থে প্রয়োগ করতে পারেন। প্রচলিত অনুসঙ্গের বাইরে শব্দের এই ব্যবহার অর্থগত বিচ্যুতি ঘটায়, ফলে কাব্য ও কবিতা অভিনব ব্যাঞ্জনায় ঋদ্ধ হয়ে ওঠে।

অন্ধকার দিয়ে ঢাকে লাল দীঘির ‘ লাল অন্ধকার’ (অন্ধকারের রঙ কালো। কিন্তু লাল অন্ধকার হয়ে ওঠে এক বিশেষ তাৎপর্য সূচক)

এই নিরন্ধ্র নিকষ ‘কালোর অবয়বে’ (নিকষ কালোর অবয়ব নেই কিন্তু কঠিন শব্দের বিশেষনীয় প্রয়োগে নিরাবরণ কালোকেও দেওয়া হয়েছে আকৃতি)।

৪. ধ্বনিগত বিচ্যুতি :
কবিতার বহির্গঠনকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয় ধ্বনিগত বিচ্যুতি। মুখের ভাষার মত কবিতার ভাষাও ধ্বনিগত পরিবর্তনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন লোপ(deletion), সংযোজন (insertion), রূপান্তর (modification) ইত্যাদি।

সুনীল আকাশ ‘পরে শুভ্র মেঘ থরে থরে।(উপরে)

মুখানি থুয়ে তার মুখে।(মুখখানি)

কলঙ্কের কথা দরিদ্রের আশ।(আশা)

একটু খানি রূপের হাসি আঁধারেতে ঘুমিয়ে আলা।(আলো)

৫. লৈখিক বিচ্যুতি :
লেখরীতিগত বিশেষত্বের মাধ্যমেও কবিতাকে অর্থবহ করে তোলা সম্ভব।

এই শিকল পড়া ছল মোদের এ
শিকল পড়া ছল।
এই শিকল পড়েই শিকল তোদের
করবে রে বিকল।

উদাহরনে প্রতি চরনের প্রথম পদটির সঙ্গে অন্যান্য পদগুলির দুরত্ব বা ফাঁক বজায় রাখা হয়েছে।

৬. ঔপভাষিক বিচ্যুতি :
মান্য চলিত ভাষাই মূলত সাহিত্যের ভাষা। কিন্তু লেখক প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষাও ব্যবহার করে থাকেন।

এজ্ঞে বাবু, আপনি হক কথাই কন। আমাগো গরীবদের রাগ থাকতে নাই।

৭.ভাষামূদ্রা-আশ্রিত বিচ্যুতি :
আধুনিক কবিতা বর্তমানে বিভিন্ন ভাষা মুদ্রা ব্যবহার করেন।

দেয়াল-কাগজ হলদে, পেরেকের বহু দাগ,ডেকে ওঠে সিমেন্ট ( না সোডিয়াম )

৮. ইতিহাসাশ্রিত বিচ্যুতি :
লেখার সময় লেখক শুধু সমকালে আবদ্ধ থাকেন না। প্রয়োজনে তিনি পাঠককে পোছে দিতে পারেন সুদূর অতীতে।

তোমার বাহুতে অনন্ত সৃষ্টি ‘ক্রতুকৃতমের’ শেষ।

বুদ্ধি আমার ‘অপাপবিদ্ধমস্নাবির’।

তথ্যসংগ্রহ :
১.শৈলী চিন্তাচর্চা – বিপ্লব চক্রবর্তী
২. শৈলীবিজ্ঞান : শৈলীতত্ত্ব – উদয়কুমার চক্রবর্তী
৩. কবিতার শৈলী এবং কবিপঞ্চক – ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়
৪. ছন্দের বারান্দা – শঙ্খ ঘোষ
৫. রীতির সন্ধানে – অরুন ঘোষ
৬. শৈলীবিজ্ঞান এবং আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব – অভিজিৎ মজুমদার

আলোচক – অমিয় বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *