বাংলা সাহিত্যমনসামঙ্গল কাব্য

মঙ্গলকাব্য – একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের ধারায় বিশেষ এক শ্রেশির আখ্যানকাব্য লেখা হয়েছে। এগুলিই মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে বিকাশের ধারায় এই মঙ্গলকাব্যগুলির অবদান কম নয়। এই শ্রেণির কাব্যধারায় আমরা পেয়েছি বিশিষ্ট কবিদের। যেমন মুকুন্দ চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, বিজয়গুপ্ত, ভারতচন্দ্র রায় সহ আরও অনেক কবিকে। আমাদের এই আলোচনায় মঙ্গলকাব্যের সাধারণ পরিচিতি ও তার বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরা হয়েছে।

মঙ্গলকাব্য কী ?

‘মঙ্গল’ শব্দটির সাধারণ অর্থ ‘শুভ’ বা ‘কল্যাণ’। কিন্তু মঙ্গলকাব্যে এই শব্দের ব্যবহারের কারণ সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা প্রচলিত। কেউ মনে করেন, এক মঙ্গলবার থেকে অন্য মঙ্গলবার পর্যন্ত গাওয়া হত বলে এই আখ্যানের নাম মঙ্গলকাব্য।

ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের অনুমান ‘মঙ্গল’ নামক সুর থেকে মঙ্গলকাব্য নামের উৎপত্তি হয়েছে। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, যে গানে মঙ্গলকারী দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণণা করা হয়, যে গান মঙ্গল সুরে গাওয়া হয় তাকেই মঙ্গলকাব্য বলা হয়ে থাকে। তামিল ভাষায় ‘মঙ্গল’ শব্দের অর্থ ‘বিবাহ’। আবার হিন্দিতে এর অর্থ ‘মেলা’।

ফলে অভিমত, কোনো কাব্যের সঙ্গে ‘মঙ্গল’ শব্দ যুক্ত থাকলেই তা মঙ্গলকাব্য গোষ্ঠীভূক্ত নাও হতে পারে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘চৈতন্যমঙ্গল’, ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ ইত্যাদি। ‘মঙ্গল’ শব্দটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে আধুনিক কালের অনেক কবিই ‘মঙ্গল’ শব্দযুক্ত কাব্য রচনা করেছেন। যেমন বিহারীলাল চক্রবর্তী লিখেছেন ‘সারদামঙ্গল’।

রচনাপদ্ধতি

প্রায় প্রত্যেকটি মঙ্গলকাব্যের গঠনকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন – বন্দনা অংশ, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ ও আত্মপরিচয়, দেবখণ্ড এবং নরখণ্ড।

ক. বন্দনা অংশ

বন্দনা অংশে দেবদেবীর বন্দনা দিয়ে সূচনা হয়েছে এই কাব্যধারার যেকোনো আখ্যানের। কিন্তু এই অংশে কেবল একটি দেব বা দেবীর বন্দনাই নয়, অনেকসময় একাধিক দেব বা দেবীর মাহাত্ম্যকীর্তন করা হত। শুধু তাই নয়, দেবতাদের সঙ্গে কবি তাঁর পিতামাতা তথা অন্য গুরুজনদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাতেন। বন্দনা অংশে কবি যেন একথাই বলতে চান, তিনি সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষকে একত্রিত করার প্রয়াস করছেন।

খ. গ্রন্থোৎপত্তির কারণ ও আত্মপরিচয়

এই অংশে কাব্য রচনার কারণ সহ কবি তাঁর নিজের পরিচয় দিয়েছেন। মঙ্গলকাব্যের প্রায় সকল কবিই কাব্যটি রচনার কারণ হিসেবে তাঁদের বর্ণিত দেবদেবীর প্রত্যক্ষ আদেশ কিংবা স্বপ্নাদেশের উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি কবিগণ তাঁদের ব্যক্তিগত পরিচয় যেমন জন্ম, বাসস্থান, বংশ পরিচিতি তথা সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সুন্দর চিত্রের উপস্থাপন করেন এই অংশে।

গ. দেবখণ্ড

এই অংশে কীর্তিত দেবদেবীর স্বর্গীয় শক্তির কথা বলা হয়ে থাকে। কথিত দেব বা দেবী যে স্বর্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং তাঁর সন্তুষ্টিতে মানুষের কল্যাণ হয় এই বিশ্বাস জাগানোর চেষ্টা করা হয় দেবখণ্ডে। এই অংশটিতে যে সমস্ত বিষয়ের অবতারণা করা হত তা হল সৃষ্টিরহস্য কথন, সতীর দেহত্যাগ, মদনভষ্মের কাহিনি, হর-গৌরীর কোন্দল, শিবের ভিক্ষাযাত্রা ইত্যাদি। এই অংশে পৌরাণিক ও লৌকিক দেবদেবীর সমন্বয় ঘটানোই হল মূল বিষয়। দেখা যায় স্বর্গের দেবদেবীরা নানা কারণে অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যলোকে মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করে বিশেষ দেবদেবীর পুজো প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছেন।

ঘ. নরখণ্ড

এই অংশটিতে মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বারমাস্যার কথা, প্রতিদিনের জীবনযাপনের পরিচয়, নারীর পতিনিন্দা এসবের প্রাধান্য। তবে সমস্ত কাহিনি সংশ্লিষ্ট দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে আবর্তিত হয়। দেবখণ্ডের শাপভ্রষ্ট দেবদেবীরা নরজীবনের দুঃখ-কষ্ট ভোগের পর দেবতার পুজো প্রচারে সমর্থ হন এবং কর্মশেষে স্বর্গলোকে ফিরে যান।

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়