অন্যান্য সাহিত্যিক

হিরণ্ময়ী দেবী – বিশিষ্ট কবি

বাংলা কাব্যসাহিত্যে একজন বিশিষ্ট মহিলা কবি হলেন হিরণ্ময়ী দেবী । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু সুমধুর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর কবিতায় আছে জীবনরহস্যের প্রশ্ন, পৃথিবীর বিচিত্র রহস্যের বিশ্লেষণ। শুধু কবিতা রচনাই নয়, পাশাপাশি তিনি সম্পাদনা করেছেন সাময়িক পত্রিকারও।

জন্ম ও বংশ পরিচয়

হিরণ্ময়ী দেবী -এর জন্ম ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায়। পিতা জানকীনাথ ঘোষাল ছিলেন দেশ-সেবী মানুষ। কবির মাতা ছিলেন বিখ্যাত মহিলা ঔপন্যাসিক ও কবি স্বর্ণকুমারী দেবী। অন্য পরিচয়ে হিরণ্ময়ী দেবী ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্রী। কবির দাম্পত্যসঙ্গী ছিলেন ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। উভয়ের বিবাহ হয়েছিল ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। স্বামীর কর্মের সুবাদে তাঁকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে হয়েছিল।

শিক্ষা ও সাহিত্যানুরাগ

বাল্য বয়স থেকেই হিরণ্ময়ীর বিদ্যাশিক্ষার প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি ছোটো বয়স থেকেই কবিতা রচনা করতে থাকেন। জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। একের পর এক সন্তান শোক পেলেও তাঁর কবিতা চর্চা থেমে থাকেনি। মাত্র বারো বছর বয়স থেকেই তিনি ছোটোদের জন্য কবিতা রচনা শুরু করেন। তাঁর কবিতাগুলি ‘সখা’, ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয়।

কেবল কবিতা রচনাই নয়, এর পাশাপাশি কবি সম্পাদনা করেছেন সাময়িক পত্র -এরও। ১৩০২ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩০৪ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ছোটো বোন সরলা দেবীর সঙ্গে একত্রে সম্পাদনা করেছেন ‘ভারতী’ পত্রিকার।

কর্তব্যনিষ্ঠা

হিরণ্ময়ী দেবী একজন সহৃদয় সমাজসেবী মহিলা ছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবী প্রতিষ্ঠিত ‘সখি সমিতি’র তিনি কর্ত্রী ছিলেন। একসময় এই সমিতি বন্ধ হবার উপক্রম হলে তিনি নিজের অর্থব্যয়ে তা রক্ষা করেন। একটি বিধবা শিল্পাশ্রম খুলেছিলেন তিনি যার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গের মহিলাদের কর্মমুখী করে তোলা। মেয়েদের দুঃখ কষ্ট দূর করে তাদের সুশিক্ষিতা করে তোলার অভিপ্রায় ছিল তাঁর।

নিজের পরিবারের প্রতিও ছিল তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের কথা। তিনি লিখেছেন,

        ‘হিরণ্ময়ী দেবীর একটি বিশেষ গুণ ছিল –সেটি তাঁর অনন্যসাধারণ পারিবারিক স্নেহ ও কর্তব্যনিষ্ঠা। পিতা-মাতার প্রতি অসীম ভক্তি তাঁহার প্রতি কাজে পরিষ্ফূট হইত। সন্তানগণের শিক্ষার জন্য তিনি শুধু অর্থব্যয় করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন না, নিজে নিকটে বসিয়া তত্ত্বাবধান করিতেন।’

সাহিত্যচর্চা

আগেই জানিয়েছি যে, হিরণ্ময়ী দেবীর কবিতাগুলি নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘সখা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভাইবোনের দোলনা’ কবির প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবির ‘প্রেমফোটা’, ‘কিরণের মৃত্যু’ ও ‘বসন্তের পাখি’ ভারতীতে প্রকাশ পায় যথাক্রমে অগ্রহায়ণ ১২৯৩ বঙ্গাব্দ, ফাল্গুন ১২৯৩ বঙ্গাব্দ এবং আষাঢ় ১২৯৪ বঙ্গাব্দে। তাঁর কবিতায় ‘মগ্নচারিতা’, ‘প্রকৃতি সম্ভোগ’ ও ‘মর্ত্য আসক্তি’ দেখেছেন সমালোচক সুরেশচন্দ্র মৈত্র। তাঁর ‘নতুন জীবন’ কবিতায় পাওয়া যায় অধ্যাত্মজীবনের প্রসঙ্গ। কবি লিখেছেন –

        ‘দেখ চেয়ে একবার                অসীম রহস্যময়

অনন্ত এ বিশ্ব

দেখ সেথা কিবা গায়              কোন কথা বলে যায়

প্রতি নব দৃশ্য।’

সমালোচক সুরেশচন্দ্র মৈত্র লিখেছেন, ‘কবি হিরণ্ময়ী দেবী সংসার-আশ্রম থেকে অন্য আশ্রমের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন।’ উক্ত কবিতায় পৃথিবীর অভাবনীয় রহস্যের বিশ্লেষণ করেছেন।

মৃত্যু

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুলাই হিরণ্ময়ী দেবীর মৃত্যু হয়।

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়, বাংলা শিক্ষক, পূর্ব বর্ধমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *