অন্যান্য সাহিত্যিকনাটক ও থিয়েটার

বিজন ভট্টাচার্য – জীবন ও সাহিত্য

বাংলা নাট্যসাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য । তিনি কেবল নাট্য রচয়িতাই নন, ছিলেন একজন গায়ক, সুরকার এবং অভিনেতাও। দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তরের পটভূমিকায় রচিত তাঁর ‘নবান্ন’ নাটকের কথা সকলেই জানেন। আমাদের এই আলোচনায় তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্য এবং লেখকের বিভিন্ন রচনা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

জন্ম ও শৈশব

বিজন ভট্টাচার্যের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই। পিতা ক্ষিরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন শিক্ষক। পিতার আদর্শ, সাহিত্য ও সঙ্গীতানুরাগ তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। গ্রাম-বাংলার দৈনন্দিন জীবনের নানা দিক, গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন পিতার সূত্রেই। গ্রামাঞ্চলের নানা সংস্কৃতি ও মেলায় যেতে পছন্দ করতেন। আর সেই সুবাদেই আঞ্চলিক কথ্যভাষার সঙ্গে পরিচিত হন যা তাঁর অনেক লেখায় প্রত্যক্ষ করা যায়।

শিক্ষা ও কর্মজীবন

বিজন ভট্টাচার্য কলকাতার আশুতোষ কলেজে পাঠরত ছিলেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীকালে তিনি রিপন কলেজেও কিছুদিন পড়াশোনা করেন। এই সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩১-‘৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেন। শুধু তাই নয়, ১৯৩৪-‘৩৫ খ্রিস্টাব্দের ছাত্র-আন্দোলনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট দলে যোগ দেন। এই সময় তিনি একদিকে যেমন ভারত-ছাড়ো আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তেমনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (IPTA) গঠনেও বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজের নাট্যদল ‘ক্যালকাটা গ্রুপ থিয়েটার’ তৈরি করেন। আরো পরে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা গ্রুপ ছেড়ে ‘কবচকুণ্ডল’ নাট্যপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেন।

দাম্পত্য জীবন

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিবাহ করেন বিখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীকে। উভয়ের সন্তান নবারুণ ভট্টচার্য যিনিও বিখ্যাত সাহিত্যিক হিসেবে সুপরিচিত। তবে মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে লেখকের বৈবাহিক জীবন স্থায়ী হয়নি।

সাহিত্য জীবন

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একজন প্রথম সারির নাট্যকর্মী ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব ঘটে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘অরণি’ পত্রিকার মাধ্যমে। এই সময় তিনি মূলত গল্প ও অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতেন। তবে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি মূলত নাট্যকার হিসেবেই। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ পায় প্রথম নাটক ‘আগুন’। আঙ্গিকের দিক থেকে এটি একটি একাঙ্ক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের পরবর্তী খাদ্যাভাব পূরণে রেশন ব্যবস্থার প্রচলন এবং সেই ব্যবস্থায় মানুষের নানা বিভ্রান্তি এই একাঙ্কের বিষয়। দৃশ্য সংখ্যা পাঁচটি। একাঙ্কটি ঐ বছর নাট্যভারতীতে অভিনীত হয়।

লেখকের অন্যান্য নাটক

১. জবানবন্দি (১৯৪৩) চারটি দৃশ্যে রচিত এই নাটকে কৃষক পরিবারের মর্মান্তিক পরিণতি দেখানো হয়েছে।

৩. অবরোধ (১৯৪৭) শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত ছয় অঙ্কের নাটক। চরিত্রগুলি হল হেমেন সেন, সাবিত্রী, ঈশ্বর পন্ডিত।

৪. জীয়নকন্যা (১৯৪৮) এটি একটি গীতিনাট্য। নাটকটি বেদে জীবনকথা অবলম্বনে রচিত।

৫. কলঙ্ক (১৯৫০) দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে সাঁওতাল পরিবারের কথা ব্যক্ত হয়েছে এই নাটকে। নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল গিরি, রত্না, মঙ্গল।

৬. জতুগৃহ (১৯৫১) এটি একটি পারিবারিক নাটক। চার অঙ্কের এই নাটকের মুখ্য চরিত্রগুলি হল কল্যাণী, অসীম, লতা, রসময়, রঞ্জন, সুহাস।

৭. গোত্রান্তর (১৯৫৭) উদ্বাস্তু এক শিক্ষক কিভাবে বস্তির শ্রমিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে এই নাটকে। নাটকের মুখ্য চরিত্রগুলি হল চরিত্রগুলি হল হরেন, গৌরী, কানাই।

৮. মরাচাঁদ (১৯৬০) একজন শিল্পীর জীবনের নানা অনুভূতি, ঘটনাক্রম দেখানো হয়েছে এই নাটকে। চরিত্রগুলি হল পবন অধিকারী, শচীন, রাধা।

৯. দেবীগর্জন (১৯৬৬) বিজন ভট্টাচার্যের এই নাটকে কৃষক বিদ্রোহের স্বরূপ ধরা পড়েছে। তিন অঙ্কের এই নাটকের মুখ্য চরিত্রগুলি হল মংলা, দশরথ, রত্না।

১০. কৃষ্ণপক্ষ (১৯৬৬) ইবসেনের প্রভাব আছে এই নাটকে।

১১. গর্ভবতী জননী (১৯৬৯) বেদে জীবনের নানা সংস্কার, বিশ্বাস নিয়ে রচিত এই নাটকটি। নাটকের মুখ্য চরিত্রগুলি হল কালী, সুবল, রতন।

১২. লাশ ঘুইর‍্যা যাউক (১৯৭০) ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে রচিত নাটক। চরিত্রগুলি হল সুরেন, নানু, পল্লব।

১৩. আজ বসন্ত (১৯৭০) তিন অঙ্কের এই নাটকে আছে প্রেম ও রোম্যান্টিকতা। চরিত্রগুলি হল সুবিনয়, মীরা, কেদার, উমেশ।

১৪. সোনার বাংলা (১৯৭১) বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর রচিত নাটক। মূল চরিত্র গাজী।

১৫. চল সাগরে (১৯৭২) ব্রিটিশ শাসনের শেষ লগ্ন এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপর ভিত্তি করে রচিত নাটক। চার অঙ্কের এই নাটকের মূল চরিত্র সুরেন ডাক্তার।

১৬. হাঁসখালির হাঁস (১৯৭৭) সর্বহারা মেহনতি মানুষের কথা বলা হয়েছে এই নাটকে। উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল পরমেশ্বর, যজ্ঞেশ্বর, জনার্দন প্রমুখ।

জনপ্রিয় নাটক

তবে বিজন ভট্টাচার্যের সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটক হল ‘নবান্ন’ (১৯৪৪)। পঞ্চাশের মন্বন্তর, আগষ্ট আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এই নাটক। নাটকটি চারটি অঙ্কে রচিত। উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল প্রধান সমাদ্দার, কুঞ্জ, নিরঞ্জন, দয়াল মন্ডল, নির্মল, রাধিকা। ভারতীয় গণ নাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায় এবং বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় নাটকটি ঐ বছরেই প্রথম মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বহুরূপী নাট্যদলের প্রযোজনায় নাটকটি পুনরায় মঞ্চস্থ হয়।

অন্যান্য কীর্তি

কেবল দক্ষ নাট্যকারই নয়, বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন একজন সু-অভিনেতাও। বিনয় ঘোষের ‘ল্যাবরেটরি’ গ্রন্থের নাট্যরূপ দান করে তাতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। অভিনয় করেছেন নিজের লেখা বহু নাটকেও। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল বেন্দা, প্রধান সমাদ্দার, পবন, হরেন মাস্টার, কেদার, সুরেন ডাক্তার, প্রভঞ্জন ইত্যাদি।

নাট্য নির্দেশক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। গণনাট্য সংঘে তিনি তাঁরই লেখা ‘জবানবন্দী’ ও ‘নবান্ন’ নাটকের প্রযোজনা করেছেন।

মৃত্যু

১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি এই প্রথিতযশা নাট্যকারের দেহাবসান হয়।

লেখক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়, বাংলা শিক্ষক, পূর্ব বর্ধমান

তথ্যসূত্র – সংসদ বাংলা চরিতাভিধান, বাংলা নাটকের ইতিহাস, ‘বাংলা সাহিত্যঃ রচনাকোশ’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *